বাংলাদেশঃ রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের জন্য সীমান্ত খুলে দিন

পশ্চিম মায়ানমারে সম্প্রতি রোহিঙ্গা এবং রাখাইনদের মাঝে সংগঠিত জাতিগত হানাহানির প্রেক্ষাপটে শরণার্থীদের বিপুল হারে প্রবেশের আশঙ্কায়, বাংলাদেশ সরকার তার সীমান্ত, উপকূল রক্ষী এবং স্থানীয় প্রশাসনকে, মায়ানমার সীমান্তে নজরদারি পরিমাণ আরো বাড়িয়ে দেওয়ার আদেশ প্রদান করে। এই সিদ্ধান্ত মানবাধিকার সংগঠন এবং জাতিসংঘকে নিঃসন্দেহে বিস্মিত করেছে, কারণ এর আগে দেশটি হাজার হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থীকে আশ্রয় প্রদান করেছে, যারা বিগত তিন দশক সময় ধরে রাষ্ট্রীয় দমনের কারণে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। বাংলাদেশের নেট নাগরিকরা মানবিক কারণে সরকারের সিদ্ধান্তের বিষয়ে প্রশ্ন করেছে, যদিও তারা স্বীকার করে নিয়েছে যে দেশটি আর বাড়তি উদ্বাস্তুদের আশ্রয় দানে সক্ষম নয়।

মায়ানমারের সংখ্যালঘু রোহিঙ্গারা এশিয়ার সবচেয়ে নিপীড়িত জাতি হিসেবে চিহ্নিত । মায়ানমারে প্রায় ৮০০,০০০ জন এবং উদ্বাস্তু হিসেবে বাংলাদেশে প্রায় ২০০,০০০ জন রোহিঙ্গা দুর্দশাগ্রস্ত এক পরিস্থিতিতে বাস করে। রোহিঙ্গা ব্লগার সংবাদ প্রদান করছে:

রোহিঙ্গাদের প্রতি সব সময় এক তীব্র বৈষম্য বজায় রাখা হয়েছে। তারা মায়ানমারের অন্য প্রদেশে যেতে পারে না, বলা যেতে পারে কৌশলগত ভাবে তাদের পুলিশ বাহিনীতে চাকুরী প্রদান করা হয় না, এমনকি তাদের নাগরিকত্ব নেই, যদিও এই বিষয়টি নিয়ে সংসদে প্রশ্ন করা হয়েছে , কিন্তু হঠাৎ করে তাদের উপর অত্যাচারের পরিমাণ বেড়ে গেছে। [..]

বার্মা স্বাধীন হবার পর থেকে শত শত, হাজার হাজার রোহিঙ্গা, কেবল তাদের স্বদেশী বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী রাখাইনদের হাতে নয়, একই সাথে বার্মার সরকার দ্বারা বর্ণবাদী এবং ধর্মীয় নির্যাতনের কারণে সীমান্ত পাড়ি বাংলাদেশে প্রবেশ করতে থাকে।

মায়ানমারের অস্থিতিশীল পরিস্থিতির কারণে অনেক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অভিবাসী হচ্ছে, ছবি খামিন–এর, কপিরাইট ডেমোটিক্সের।

রোহিঙ্গা ব্লগার উল্লেখ করছে এই সমস্ত নাগরিকদের অনলাইনে “বাঙ্গালী” উল্লেখ করে একই সাথে সেখানেও তাদের নিপীড়ন করা হচ্ছে:

অনলাইনে পোস্ট করা মায়ানমারের অনেক নাগরিকের মন্তব্যে জাতিগত শুদ্ধি অভিযান চালানো দাবি জানানো হয়েছে।

হাফিংটন পোস্ট-এ টড পিটম্যান এই জাতিগত ঘৃণার পেছনের কারণ ব্যাখ্যা করে লেখা পোস্ট করেছেন:

মায়ানমার সরকার বেশীরভাগ রোহিঙ্গাকে অবৈধ বাংলাদেশী অভিবাসী হিসেবে চিহ্নিত করে, যদিও এমন কি প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে তাদের পরিবার মায়ানমারে বাস করে আসছে। বাংলাদেশ দৃঢ়তার সাথে তাদের অস্বীকার করে।

হংকং–এ মায়ানমারের কাউন্সেল জেনারেল-বর্তমানে যিনি জাতিসংঘের রাষ্ট্রদূত, তিনি, কূটনীতিবিদদের মাঝে প্রদান করা এক উন্মুক্ত চিঠিতে রোহিঙ্গাদের দানবের মত কুৎসিত হিসেবে উল্লেখ করেন, তিনি রোহিঙ্গাদের কালো বাদামী চামড়ার সাথে সংখ্যাগরিষ্ঠ বর্মী জাতীর “সুন্দর এবং মসৃণ” চামড়ার সাথে তুলনা করে তা বলেন। […]

আগুন ছড়িয়ে পড়ার পর বার্মার এক অভিনেত্রী সোমবারে তার ফেসবুকের ওয়ালে পোস্ট করা লেখায় বলেন, আমি তাদের শতভাগ ঘৃণা করি” । বৃহস্পতিবারের মধ্যে তার এই মন্তব্যে ২৫০ জন “লাইক” প্রদান করে।

বাংলাদেশী নেট নাগরিকরা এই বিষয়ে দ্বিধাবিভক্ত, বিশেষ করে কি ভাবে এই সমস্যার সমাধান করা হবে এই নিয়ে যখন একটি তীব্র বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। ব্লগার প্রবীর বিধান আমাদের স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন, ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার যুদ্ধের সময় বাংলাদেশের প্রায় ১ কোটি শরণার্থী প্রতিবেশী ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করেছিল এবং যাদের বেশীর ভাগ পরে ফিরে আসে। তিনি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর কাছে এক আহবান জানিয়েছেন [বাংলাদেশ]: :

এদের চিকিৎসা নিশ্চিত করুন এবং দাঙ্গা না থামা পর্যন্ত কিছুদিনের জন্য এদের থাকতে দিন;পাশাপাশি এখন থেকেই কূটনৈতিক কার্যক্রমকে এগিয়ে নিন। যেন পরিস্থিতি শান্ত হলে সকল শরনার্থীদের ফেরত পাঠানো যায়।

সুলতান মির্জা উল্লেখ করেছেন [বাংলা ভাষায়] যে এমনকি জাতিসংঘ এবং অন্য সব আন্তর্জাতিক ত্রাণ সংস্থার সাহায্য পাবার পরেও অনেক রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু বাংলাদেশে শরণার্থী শিবিরে অবর্ণনীয় অবস্থায় বাস করছে। তিনি লিখেছেন:

শরনার্থী শিবিরে রোহিঙ্গারা বসবাস করছে মানবেতর অবস্থায়। বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গারা বিভিন্ন ধরনের অপরাধমূলক কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়ছে। কক্সবাজার, টেকনাফ সীমান্ত এলাকায় রোহিঙ্গা শরণার্থীরা যুক্ত হয়ে পড়েছে মাদক ব্যবসায়ের সাথে। চোরাপথে অস্ত্র ও মাদক ব্যবসায়ে রোহিঙ্গাদের সম্পৃক্ততার প্রমাণ আছে। তাছাড়া দেশে জঙ্গী শক্তি বিকাশে রোহিঙ্গারা সম্পৃক্ত তারও প্রমাণ আছে।

দশক ধরে এই সব শরণার্থীদের মায়ানমারে ফেরত না পাঠাতে পারার জন্য সুলতান মির্জার পোস্টের নীচে উত্তরপুরুষ জাতিসংঘের সমালোচনা করেছেন এবং সেই সাথে এক জনপ্রিয় ষড়যন্ত্র তত্ত্ব উন্মোচন করেছে:

বাংলাদেশের জামাত ও জামাত পন্থী গোষ্ঠী সমূহ এবং কিছু আরব দেশ কিন্তু খানিকটে বাড়িয়েই চিন্তা করছে গত কয়েক দশক যাবত আর সেটি হচ্ছে পার্বত্য চট্টগ্রাম ও আরাকানকে নিয়ে একটি মুসলিম রাষ্ট্র গঠন করার পরিকল্পনা।

ইসলামী ছাত্র মোর্চা, মায়ানামারে রোহিঙ্গা মুসলমানদের নিধনের বিরুদ্ধে এক শোভাযাত্রার আয়োজন করে। মায়ানমারের জাতিগত দাঙ্গার ঘটনায়, শত শত মুসলমান বাংলাদেশে প্রবেশের চেষ্টা করছে, কিন্তু তাদের অনেককে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে। ছবি ফিরোজ আহমেদের। কপিরাইট ডেমোটিক্সের (১৪ জুন, ২০১২)।

সম্প্রতি বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডঃ দিপু মনি সংসদে জানান [বাংলা ভাষায়] যে মায়ানমার, বাংলাদেশের কাছে অভিযোগ করেছে যে জামাত-এ –ইসলাম দেশটিতে অস্থিরতার সৃষ্টি করেছে। তিনি আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থার কাছে আবেদন জানান যেন তারা মায়ানমারের অভ্যন্তরে বসবাসরত রোহিঙ্গাদের সাহায্য করে, বিশেষ করে যখন মায়ানমারের বিরুদ্ধে আরোপিত নিষেধাজ্ঞা উঠিয়ে নেওয়া হয়েছে।

ব্লগার এবং কবি ব্রাত্য রাইসু তার ফেসবুক ওয়ালে, রোহিঙ্গারা অনেকে অপরাধের সাথে জড়িয়ে পড়ছে এই অজুহাত শরণার্থীদের গ্রহণ না করার সরকারের এই সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেছেন। এই ডিজিটাল সন্ন্যাসী প্রশ্ন করেছেন:

রোহিঙ্গাদের রক্তের রঙ কি কালো? সব রোহিঙ্গা কি অপরাধী? নিষ্পাপ শিশুগুলো ও কি ইয়াবা পাচার করে?

ব্লগার সৈয়দ রিয়াজ [বাংলা ভাষায়] ব্যাপকভাবে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে প্রবেশের ইতিহাস সম্বন্ধে জানাচ্ছে, যার শুরু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়, যখন জাপান বার্মা দখল করে নেয়। সে সময় রোহিঙ্গারা ব্রিটিশ বাহিনীর পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করে। পরে জাপানিরা আরাকান দখল করে নির্বিচারে রোহিঙ্গাদের হত্যা করে। সে সময় ৪০ হাজার রোহিঙ্গা ব্রিটিশ শাসনাধীন অধীনে পার্বত্য চট্টগ্রামে পালিয়ে আসে।

সৈয়দ রিয়াজ এর সাথে যোগ করেছেন যে ১৯৯১-৯২ সালে মায়ানমারে রোহিঙ্গাদের উপর আবার অত্যাচার- শুরু হয়। সে সময় ২৫০,০০০ জন রোহিঙ্গা সীমান্ত পাড়ি দেয়। কেউ যদি এই সমস্ত রোহিঙ্গাদের আশ্রয় না দেয়, তাহলে এই সমস্ত গৃহহীন রোহিঙ্গারা যাবে কোথায়?

মনিরুজ্জামান সজল লিখেছেন [বাংলা ভাষায়]:

আমি নিজেও চাই না ওরা মারা যাক। কিন্তু আমরা আর কত করবো? জাতিসংঘ এগিয়ে আসা মানে বাংলাদেশও এগিয়ে আসা। বাংলাদেশ জাতিসংঘের বাইরে নয়। আর অন্যদিকে জাতিসংঘ বাংলাদেশের উপর দায়িত্ব চাপিয়ে দিয়ে নিজেদের দায়িত্বকে এড়িয়ে যাচ্ছে।

কবি এবং ব্লগার টোকন ঠাকুর তার ফেসবুকের স্ট্যাটাসে মায়ানমারের বিরোধী নেত্রী অং সান সূচির সমালোচনা করেছেন [বাংলায়]:

মিয়ানমার বা প্রতিবেশি বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের নিজেদের নাগরিক বলে স্বীকার করে না। মিয়ানমার সরকার ও বার্মিজ জাতির অনেকেই তাদের ‘রোহিঙ্গা’ বলেও স্বীকার করে না,তাদের ‘বাঙালি’ হিসেবে চিহ্নিত করে।'কী দুর্ভাগ্য এই মানুষগুলোর! এদের একটি দেশ নেই! তাহলে পৃথিবীর সঙ্গে ‘রোহিঙ্গা’দের সম্পর্কটা কী? একজন রোহিঙ্গা শিশু পৃথিবীকে কীভাবে দেখছে আজ? মন খুব বিষণ্ন হয়ে যাচ্ছে আমার। নোবেল বিজয়ী মার্কিনী গণতন্ত্রের উজ্জয়িনী অং সান সুচি এখন ব্যস্ত ইউরোপ সফরে।

বাস্তবতা হচ্ছে সূচি মায়ানমারের সাম্প্রতিক সংঘর্ষের দেশটির নাগরিক আইনকে পরিষ্কার করার আহবান জানান। হাবিব সিদ্দিকি, দাও আং সান সূচির প্রতি একটি খোলা চিঠি লিখেছেন, নাগরিক অধিকার-এর বিষয়ে সবার সমঅধিকারের দাবীর জন্য।

যদি আপনি বাংলাদেশ সরকারে কাছে আবেদন জানাতে চান, যেন সরকার রোহিঙ্গাদের জন্য দ্বার বন্ধ না করে রাখে, তাহলে এখান এবং এখানে লেখা দরখাস্তে স্বাক্ষর করতে পারেন ।

আলোচনা শুরু করুন

লেখকেরা, অনুগ্রহ করে লগ ইন »

নীতিমালা

  • অনুগ্রহ করে অপরের মন্তব্যকে শ্রদ্ধা করুন. যেসব মন্তব্যে গালাগালি, ঘৃণা, অবিবেচনা প্রসূত ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকবে সেগুলো প্রকাশের অনুমতি দেয়া হবে না .