বাংলাদেশ: সাংবাদিকদের পুলিশ থেকে নিরাপদ দূরত্বে থাকার উপদেশ

বিশেষ করে ২০১২ সাল বাংলাদেশী সাংবাদিকদের জন্যে একটি খারাপ বছর। কর্মরত বহু সাংবাদিকের উপর পুলিশ এবং মাস্তানেরা চড়াও হয়েছে, বেশ কয়েকজন সাংবাদিক সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছেন এবং অনেকে নিহত হয়েছেন যেমন কয়েক মাস আগে সংঘটিত বহুল আলোচিত অমীমাংসিত হত্যাকাণ্ডের শিকার সাংবাদিক দম্পতি

নেটনাগরিকরা উক্ত দম্পতি’র হত্যাকাণ্ডের বিচারের দাবী জানিয়ে সাংবাদিকদের সাথে বেশ কয়েকটি মিছিল, মানববন্ধন, ছবি/বাদ্যযন্ত্র প্রদর্শনীতে যোগ দিয়েছে। ওদিকে গত ২৬শে মে, ২০১২ ঢাকার আগারগাঁওয়ে পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের সামনে একটি ছাত্র বিক্ষোভের সংবাদ সংগ্রহ করার সময় পুলিশ বাহিনী তিনজন ফটোসাংবাদিককে নির্মমভাবে পেটালে সাংবাদিকদের বিষাদ আরো বেড়ে যায়।

একটি ছাত্র বিক্ষোভের ছবি তোলার সময় বাংলা দৈনিক প্রথম আলো’র ফটোসাংবাদিক জাহিদ করিমকে পুলিশ পিটাচ্ছে। ঢাকা, বাংলাদেশ। ২৬শে মে, ২০১২ খালেদ সরকার/বিডিনিউজ২৪.কম-এর ছবি অনুমতি নিয়ে ব্যবহৃত

সাংবাদিকদের ভ্রাতৃত্ববোধকে নাড়া দিতে এই ঘটনাগুলোই যথেষ্ট ছিল। কিন্তু এগুলোকে ছাপিয়ে আরেকটি রক্তাক্ত ঘটনা ঘটে। গত ২৮শে মে একটি সংবাদ সংস্থা আক্রান্ত হয়। দেশের বৃহত্তম অনলাইন সংবাদপত্র বিডিনিউজ২৪.কম-এর ঢাকা শহরের আমতলীস্থ (মহাখালী) অফিসে কিছু সশস্ত্র সন্ত্রাসী কয়েকজন সাংবাদিককে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে জখম করে, যাদের মধ্যে তিনজনের অবস্থা গুরুতর।

এই ভিডিওটি ঘটনার অব্যবহিত পরেই বিডিনিউজ২৪.কম-এ আপলোড  করা হয় (সতর্কীকরণ: মর্মস্পর্শী চিত্র):

ঠিক পরের দিন আদালত প্রাঙ্গনে পুলিশের যৌন হয়রানির শিকার একজন অল্পবয়সী মহিলাকে উদ্ধার করার চেষ্টা করার সময় তিনজন আদালত সংবাদদাতা পুলিশ কর্তৃক আক্রান্ত হয়। মেয়েটি তার কিছুক্ষণ আগে তার মা-বাবার সাথে যৌতুক বিষয়ে একটি মামলা করতে আদালতে এসেছিলেন।

নেটনাগরিকরা সাংবাদিকদের উপর পুলিশ এবং অপরাধীদের এই আক্রমণে ক্ষুদ্ধ হয়। বিডিনিউজ২৪.কম ব্লগে [বাংলা ভাষায়] জায়েদ-উর-রহমানের পোস্টে এটি খুব স্পষ্ট ছিল:

এধরনের সব ঘটনার পর সবাই আন্তরিকভাবে অথবা নিয়ম করে ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত চায়, দায়ীদের শাস্তি চায়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীরা এসে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে অপরাধীকে পাকড়াও করার প্রতিশ্রুতি দেন। না, আমি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, সরকার কারো কাছে তদন্ত বিচার কিছু চাই না – শুধু জানাতে চাই একরাশ অনাস্থা তাদের প্রতি।

প্রবীর বিধান একই পোস্টে তার হতাশা প্রকাশ করেছেন:

সরকারি দলের নেতা-কর্মী এমনকি সমর্থক হলেও কত বাহারি সুযোগ-সুবিধা পাওয়া যায়! যাকে বলে কিনা সাত খুন মাফ!!! যখন তখন অস্ত্র-টাকা পয়সা-মাদক নিয়ে ঘুরা যায়, সেগুলোর যথেচ্ছ ব্যবহার করা যায়, আবার বিচারকে পাশ কাটিয়ে টিকে থাকা যায়। বিরোধী দল, প্রতিবাদী মানুষ আর সাংবাদিকদের মারলে সরকারি চামচা (নেতা-কর্মী, আমলা, র‍্যাব, পুলিশ, সেনাবাহিনী, গংদের) কোন দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয়না, হলেও আবার মাফ পেয়ে যায়।

মনিরুলসংবাদ –এর আপলোড করা এই ভিডিওটিতে সাংবাদিকদের উপর নির্যাতন, তাদের প্রতিবাদ এবং দাবি (নোট: মালিক ভিডিও সরিয়ে ফেলেছেন) দেখাচ্ছে।

সাংবাদিকদের রক্ত দেখে ব্লগার মাহবুব জামান খুবই বিমর্ষ:

ছবির ছোপ ছোপ রক্ত দেখে আজ কেঁপে উঠলাম আবারো। বুঝলাম রক্ত দেখে নির্লিপ্ত থাকার মত অমানুষ হয়ে যাইনি এখনো।

এতসব কিছুর মধ্যে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী জনাব শামসুল হক টুকুর একটি বক্তব্য অনেককে আহত করেন। ৩০শে মে এক বিবৃতিতে তিনি পরামর্শ দেন [বাংলা ভাষায়] যে সংবাদ কাভার করার সময় সাংবাদিকরা যেন পুলিশ থেকে একটি নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখে।

জনপ্রিয় কমিউনিটি ব্লগ প্রিয় কুকুর থেকে সাবধান… থুক্কু, পুলিশ থেকে সাবধান… শিরোনামের একটি পোস্টে সামাজিক মিডিয়া থেকে সমস্ত মন্তব্য জড়ো করার চেষ্টা করে সাপ্তাহিক ২০০০-এর সম্পাদক মঈনুল আহসান সাবেরের ফেসবুক স্ট্যাটাস থেকে উদ্ধৃত করেছে:

বয়স হয়েছে, সব দিকে সমান নজর দিতে পারি না। তাই ঠিক করেছি এখন থেকে সঙ্গে অল্পবয়সী কাউকে রাখব, যে পুলিশ দেখলেই আমার হয়ে সালাম দেবে।

তবে বিশিষ্ট ব্লগার ডক্টর আইজউদ্দিন শিক্ষক এবং পুলিশের মধ্যেকার একটি সাম্প্রতিক সংঘর্ষে সহকর্মী শিক্ষকদের সাথে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদ করতে গিয়ে নিহত একজন স্কুল শিক্ষকের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে সাংবাদিকদের ভূমিকার সমালোচনা করেছেন। সংবাদটি মিডিয়া প্রচার না করায় তা সরকার, সুশীল সমাজ এবং এমনকি সামাজিক মিডিয়ার অলক্ষে থেকে যায়। আইজউদ্দিন তার ব্লগে সবচেয়ে স্পষ্ট প্রশ্নটি করেছেন:

একজন সাংবাদিকের বেতন যদি হয় ৪২,০০০ টাকা আর একজন মাস্টারের বেতন হলো ৪,৭০০ টাকা তার মানে দশজন মাষ্টরের বেতনে একজন সাংবাদিক হয়- তার মানে কি দশজন মাষ্টার পড়লে আপনেরা ফেসবুক ষ্ট্যাটাস দিবেন – পুলিশ ব্রুটালিটির প্রতিবাদ জানাবেন?

একদল নেটনাগরিক ১-২ জুন তারিখে তাদের প্রোফাইল ছবিকে কালো ছবিতে মুড়ে দিয়ে ভার্চুয়াল প্রতিবাদ [ফেসবুক ঘটনার লিংক] আয়োজনের মাধ্যমে নিপীড়নের বিরুদ্ধে সাংবাদিকদের প্রতিবাদের প্রতি সংহতি জ্ঞাপন করেছে।

পুলিশ নিয়ে ক্রমবর্ধমান এই উদ্বেগ বিশ্লেষণ করে পুলিশ কর্মকর্তা ব্লগার আব্দুর রাজ্জাক উল্লেখ করেছেন যে মিডিয়াকে মোকাবেলা করার জন্যে পুলিশ বাহিনীর কাছে স্পষ্ট কোন নির্দেশনা নেই। রাজ্জাক তার ব্লগে অবস্থা পরিবর্তনের প্রয়োজনের উপর জোর দিয়েছেন:

 ইদানিং হরতালসহ অন্যান্য আইন-শৃঙ্খলা জনিত পরিস্থিতিতে পুলিশের আচরণ বিষয়ে পত্রিকায় যেসব ছবি ও খবর প্রকাশিত হচ্ছে তাতে মনে হচ্ছে পুলিশ বহুলাংশে অসহিষ্ণু হয়ে পড়েছে। আইন-শৃঙ্খলাজনিত ডিউটিতে নিয়োগের আগে ও পরে কর্তব্যরত পুলিশ সদস্যদের নিয়ে ব্রিফিং ও ডিব্রিফিং এর আয়োজন করতে হবে। এই ব্রিফিং-ডিব্রিফিং অনুষ্ঠানে রাস্তায় নিয়োজিত পুলিশের কর্তব্য ও সম্ভাব্য পরিস্থিতি নিয়ে সঠিক নির্দেশনা দিতে হবে। [..] অন্যথায় পুলিশ দ্রুত জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে।

আলোচনা শুরু করুন

লেখকেরা, অনুগ্রহ করে লগ ইন »

নীতিমালা

  • অনুগ্রহ করে অপরের মন্তব্যকে শ্রদ্ধা করুন. যেসব মন্তব্যে গালাগালি, ঘৃণা, অবিবেচনা প্রসূত ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকবে সেগুলো প্রকাশের অনুমতি দেয়া হবে না .