বাংলাদেশঃ স্বপ্নরথ, বস্তির শিশুদের জন্য এক স্কুল

স্বপ্নরথের লোগো, তৈরী করেছেন কলকাতার দিপাংশু পাল। অনুমতিক্রমে প্রকাশিত

বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায়, যখন প্রতিদিন কিছু ছেলেমেয়ে স্কুলে যওয়ার জন্য রাস্তায় বের হয়, তখন আরেক দল শিশু জাতীয় সড়কে নেমে পড়ে, জীবনের জন্য। এই সব রাস্তা তাদের জন্য জীবিকার একটা উপায়। এদের কেউ পথে আবর্জনা কুড়ায়, কেউ কেউ বিক্রি করে নানাবিধ পণ্য, যার মধ্য চা ও সিগারেট অন্যতম।

এই সব শিশুদের অনেকের জন্য স্কুল একটা স্বপ্নের জায়গা। এই সব শিশুরা যে সমাজে বাস করে সেখানে স্বপ্ন ও বাস্তবতার দূরত্ব অনেক। তবে এ রকম কিছু শিশুদের স্বপ্ন পুরণে এগিয়ে এসেছে একদল তরুণ। সমাজের সুবিধা বঞ্চিত শিশুদের জন্য তারা একটি স্কুল চালু করেছে, যার নাম “স্বপ্নরথ”।

স্বপ্নরথের স্বপ্নদ্রষ্টা শামিমা নার্গিস শিমু, তার ছাত্রছাত্রীর সঙ্গে। ছবি স্বপ্নরথের ফেসবুকের পাতা থেকে নেওয়া। অনুমতিক্রমে প্রকাশিত

যে ভাবে যাত্রা হল শুরুঃ

অফিসে আসার পথে একটি মেয়ে প্রতিদিন কিছু শিশুকে দেখতে পেত, যারা রাস্তায় আবর্জনার বাক্সে কি যেন অনুসন্ধান করছে। মেয়েটার মনে হত তারা যেন সেখানে স্বপ্নের সন্ধান করছে।

তাদের জন্য কি করা যায় তাই নিয়ে সে তার সহকর্মী এবং বন্ধুদের সাথে আলাপ করল। প্রথমে ঠিক করা হল, সপ্তাহে তারা একদিন এইসব শিশুদের একবেলা খাওয়াবে এবং তাদের কোথাও বেড়াতে নিয়ে যাবে।

স্বপ্নরথের যাত্রা শুরুর আলোচনা শুরু হয় চন্দ্রিমা উদ্যানে, ছবি স্বপ্নরথের ফেসবুকের পাতা থেকে নেওয়া। অনুমতিক্রমে প্রকাশিত

কোন অফিসে নয়, একটা উদ্যানে এই নিয়ে আলোচনা এবং কাজ শুরু করা হয়:

আর এর জন্য বেছে নেওয়া হল চন্দ্রিমা উদ্যানকে। কারণ এই পার্ক অনেক শিশুর কর্মস্থল। এরা সবাই, পার্কে বেড়াতে আসা নাগরিক কিংবা প্রেমিক প্রেমিকার কাছে ফুল, চকলেট, বাদাম, চা, সিগারেট ইত্যাদি বিক্রি করে। এই উদ্যোগে ভালোই সাড়া পাওয়া গেল। দিনে দিনে শিশুর সংখ্যা বাড়তে শুরু করল। সপ্তাহের একটি শনিবারে এদেরকে গল্প শোনানোর জন্য নিয়ে আসা হত বই, তারা কেবল নেড়ে চেড়ে দেখত। বইয়ের জগতে ঢুকতে গেলে যে শিক্ষা লাগে, আর শিক্ষার জন্য লাগে কিন্তু তাদের জন্য স্কুল যে ভিন্ন এক পথের যাত্রা। তাই তারা কেবল অক্ষর আর ছবিতে হাত রাখত। পড়ার প্রতি শিশুদের উৎসাহ দেখে এই সব তরুণেরা একটি স্কুল করার উদ্যোগ নিল, ঠিক করা হল এই স্কুলের নাম হবে স্বপ্নরথ।

গাছের তলায় স্কুল!

আনুষ্ঠানিক ভাবে একটা স্কুল চালু করতে গেলে, ভবন, বই খাতা, মাস্টার, ডাস্টার, এবং আর লাগে ছাত্রছাত্রী। কিন্তু এই স্কুলের ক্ষেত্রে নিয়মের সবটা মানা গেল না। উদ্যানের কোন গাছের নীচে প্রতি শনিবার স্কুল বসত। ছাত্রছাত্রীরা তাদের কাজ ফেলে চলে আসত স্কুলে। যদিও স্কুলে সময় দেওয়াটা তাদের জন্য ছিল এক আর্থিক ক্ষতি। কিন্তু এই শিক্ষালাভে তাদের আনন্দ ছিল অসীম। ধীরে ধীরে স্কুলে শিক্ষার্থীর সংখ্যাটা বাড়তে শুরু করল। যার ফলে এবার প্রয়োজন হয়ে পড়ল একটা ভবনের।

নতুন ক্লাশরুম ও বই-খাতা হাতে শিক্ষকদের সাথে ছাত্রছাত্রীরা। ছবি স্বপ্নরথের ফেসবুকের পাতা থেকে নেওয়া। অনুমতিক্রমে প্রকাশিত।

নতুন ঠিকানায় স্কুল!

চন্দ্রিমা উদ্যান থেকে স্কুলটিকে নিয়ে আসা হল মীরপুর ১০ নাম্বারে। এখানে একটি বাসার একটি কামরা নিয়ে শুরু হল স্কুলের যাত্রা। এখন এরা কেবল শনিবার নয়, সপ্তাহে পাঁচদিন স্কুল খোলা। নিয়মিত স্কুলে আসে ছাত্রছাত্রীরা। ৩০ জন ছাত্রছাত্রী এবং দুজন শিক্ষিকা নিয়ে স্বপ্নরথ স্কুলের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু। ক্রমশ ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা বাড়ছে, যারা সবাই সমাজের সুবিধা বঞ্চিত শ্রেণী থেকে আগত। এদের সবার বাসা বস্তিতে।

স্বপ্নরথের শিশুদের নববর্ষ উদযাপন এবং শুভেচ্ছা জ্ঞাপন। ছবি স্বপ্নরথের ফেসবুকের পাতা থেকে নেওয়া। অনুমতিক্রমে প্রকাশিত।

স্বপ্নরথ একটি বয়স্ক শিক্ষাকেন্দ্রও বটে।

শিশুদের স্কুলে যেতে দেখে অনেক বয়স্ক নাগরিক ভাবে, আহ যদি আমিও এদের মত স্কুলে যেতে পারতাম। স্বপ্নরথ নামক স্কুলটি কেবল ছোটদের জন্য নয়, বড়দের শিক্ষা কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। বর্তমানে স্কুলটিতে, ২০ জন বয়স্ক ছাত্রছাত্রী আছে, যারা শৈশবে স্কুলে যেতে পারেনি।

এই ছবিটি স্বপ্নরথের উদ্দেশ্যকে ব্যাখ্যা করে। ছবি রেমন্ড হাবিবুরের, স্বপ্নরথের ফেসবুকের পাতা থেকে নেওয়া এই ছবি অনুমতিক্রমে প্রকাশ করা হল।

স্বপ্নরথের লক্ষ্য!

ফেসবুকের পাতায় স্বপ্নরথ নিজের উদ্দেশ্য সম্বন্ধে বলছেঃ

স্বপ্ন রথ হচ্ছে একটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠান, যা ২০১০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে সমাজের সুবিধা বঞ্চিত শিশুর শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যগত উন্নয়ন।

আমাদের মত বেশীরভাগের নাগরিকের জীবনে মৌলিক চাহিদাগুলোকে নিশ্চিত করা হয়েছে, আর সেগুলো হচ্ছে, খাদ্য, পানি, বাসস্থান, স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং পরিবার। কিন্তু আমাদের দেশে এমন লক্ষ লক্ষ শিশু আছে যারা এই সব মৌলিক চাহিদা বঞ্চিত, যাদের ভবিষ্যতের কোন আশা নেই। আমাদের লক্ষ্য দেশ জুড়ে দরিদ্র শিশুদের জন্য জীবনের এই সমস্ত প্রয়োজনীয় উপাদান সরবরাহ করা এবং সংযুক্ত এক উন্নয়নের প্রতি মনোযোগ প্রদান করে দারিদ্র্যের মূলে যে সমস্ত বিষয় সেগুলোর পরিমাণ কমিয়ে আনা।

স্বপ্নরথের ছাত্রছাত্রীদের চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা, ছবি স্বপ্নরথের ফেসবুকের পাতা থেকে নেওয়া। অনুমতিক্রমে প্রকাশিত।

স্বপ্নরথের স্বপ্ন দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ। সেই লক্ষ্য তারা কেবল যাত্রা শুরু করেছে, কারণ তারা জানে তাদের যেতে হবে অনেক দুর।

3 টি মন্তব্য

এই জবাবটি দিতে চাই না

আলোচনায় যোগ দিন -> Ziaur Rahman

লেখকেরা, অনুগ্রহ করে লগ ইন »

নীতিমালা

  • অনুগ্রহ করে অপরের মন্তব্যকে শ্রদ্ধা করুন. যেসব মন্তব্যে গালাগালি, ঘৃণা, অবিবেচনা প্রসূত ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকবে সেগুলো প্রকাশের অনুমতি দেয়া হবে না .