বাংলাদেশ: বন্ধ হয়ে যাচ্ছে সিনেমা হলগুলো

সিনেমা হলে গিয়ে সিনেমা দেখা একসময় প্রতিটি বাঙালির কাছে ছিল একটি আকর্ষণীয় বিষয়। ছুটির দিনে কিংবা অন্য কোনো উপলক্ষে পরিবারের সবাই মিলে সিনেমা হলে যাওয়াও একটা ব্যাপার ছিল। সিনেমার মতো করে কথা বলা, পোশাক পরা সংস্কৃতির অংশ ছিল। বর্তমানে সিনেমা পাগল বাঙালি সিনেমা হল বিমুখ। চলচ্চিত্রশিল্প পড়েছে হুমকি মুখে। একে একে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে সিনেমা হলগুলো। সেখানে নির্মিত হচ্ছে শপিংমল। গত দশকে প্রায় হাজারের মত সিনেমা হল বন্ধ হয়েছেশুধু তাই নয়, আগে যেখানে বছরে ১০০টির মতো সিনেমা তৈরি হতো, এখন সেটা নেমে এসেছে ৩০-৪০টিতে।

সিনেমা নিয়ে নিয়মিত ব্লগ লিখে থাকেন দারাশিকো। তিনি তার ব্লগে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রশিল্পের একটি সাম্প্রতিক চিত্র তুলে ধরেছেন:

শ্যামলী সিনেমা হল এখন স্মৃতি। হল ভেঙে এখানে তৈরি হচ্ছে ১৪-তলা শপিং কমপ্লেক্স। ছবি উইকিপিডিয়ার সৌজন্যে।

বাংলাদেশের সিনেমা ইন্ডাস্ট্রি বোধহয় বর্তমানে সবচে খারাপ সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। দেশে ১৯৯০-৯১ সালে সিনেমা হলের সংখ্যা ছিল প্রায় ১২৩০টি, ২০১০ সালে এই সংখ্যা নেমে এসে দাড়িয়েছে ৭৪২-এ। ঢাকার ৪৪টি সিনেমা হলের মধ্যে এখন আছে ৩৩টি, এগারোটিকে গুড়িয়ে দিয়ে গড়ে উঠেছে বিশাল অট্টালিকা। গুলিস্তান, শ্যামলী, নাজ, লায়ন, স্টার, শাবিস্তান, তাজমহল সিনেমা হারিয়েছে অনেক আগেই। … কাহিনী আর অভিনয়ের দুরাবস্থা নিয়েও বাংলাদেশের সিনেমা ইন্ডাস্ট্রিতে বছরে ১০০টি সিনেমা মুক্তির ইতিহাসও আছে। গত এক দশকের তুলনায় ২০১০ সালে নির্মিত সিনেমার সংখ্যা সবচে কম, মাত্র ৬৩টি। ভয়াবহতার এই শেষ নয়, ২০১১ সালের প্রথম ছয় মাসে, জানুয়ারী থেকে জুন মাস পর্যন্ত মুক্তি পেয়েছে মাত্র ১৯টি সিনেমা, বিনিয়োগকৃত টাকার পরিমান মাত্র ৩০ কোটি টাকা। সম্প্রতি প্রকাশিত সংবাদে জানা গেছে এ বছরে মোট মুক্তিপ্রাপ্ত সিনেমার সংখ্যা দাঁড়াবে ৪৫-এ এবং আগামী বছরে সম্ভাব্য মুক্তিপ্রাপ্ত সিনেমার সংখ্যা মাত্র ৩০টি।

কিন্তু সিনেমা হলগুলো কেন বন্ধ হয়ে যাচ্ছে? দর্শকরা কেনইবা আগের মতো আর সিনেমা হলে যাচ্ছেন না? সিনেমা হলে না যাওয়া প্রসঙ্গে মেঘ রোদ্দুর লিখেছেন:

আমি অবশ্যই সিনেমা হলে গিয়ে বাংলাদেশে নির্মিত সিনেমা দেখতে চাই। কিন্তু কষ্টকর হলেও সত্যি অধিকাংশ সিনেমা এমনই যে সেগুলো দেখতেও রুচিতে কিছুটা আঘাত লাগতে বাধ্য। উদ্ভট সাজসজ্জা আর গল্পের সিনেমা আমি কেন দেখতে যাব? একই গল্প বার বার দেখতে কেন যাব? নকল করে সোজা কথায় কপি পেস্ট করা সিনেমা দেখতে কেন যাব?

ভাস্কর্যের পেছনে যে বিল্ডিংটি দেখা যাচ্ছে তা একসময় ছিল গুলিস্তান সিনেমা হল। এখন জামা-কাপড়ের মার্কেট। ছবি রণদীপম বসু। অনুমতি নিয়ে ব্যবহার করা হয়েছে।

সচলায়তনে একজন অতিথি ব্লগার তার পোস্টে ছোটবেলায় পরিবারের সবাই মিলে সিনেমা দেখার স্মৃতি বর্ণনা করেছেন। আর এখন সিনেমা হলে না যাওয়ার কারণ হিসেবে সিনেমা হলের পরিবেশকে দায়ী করেছেন:

এখন আর সপরিবারে সিনেমা দেখতে যাওয়া হয় না। এর জন্য আমি খারাপ ছবির দোষ দেবো না। বরং প্রেক্ষাগৃহের পরিবেশকেই বেশি দায়ী করবো। আমাদের দেশে কম করে হলেও আজও ভালো ছবি তৈরি হচ্ছে। কিন্তু সপরিবারে একসাথে একটি জায়গায় বসে তা দেখার পরিবেশ আজ আর নেই।

লেখাজোকা শামীম চলচ্চিত্রশিল্পের অধ:পতনের ৩টি কারণ উল্লেখ করেছেন:

দেশীয় সিনেমার নিম্নমান, অশ্লীল সিনেমা ও সিনেমা হলের পরিবেশের কারণে এই দেশের সিনেমা দর্শক হারিয়েছে।

অথচ একসময় সিনেমা দেখার ব্যাপারটাই ছিল অন্যরকম। অনেক আগ্রহ নিয়ে সিনেমা দেখতে যেতেন। রাসেল আশরাফ তার ব্লগে সেরকম একটা ঘটনা উল্লেখ করেছেন:

আগুনের পরশমণি দেখতে গেছি আমি আর আমার সেজ মামা। মনে করছি এই সিনেমা আর কে দেখবে সিনেমা শুরু হওয়ার একটু আগে গেলেই হবে। ওমা গিয়ে দেখি রাস্তাতে পর্যন্ত লাইন। কি আর করা! লাইনে দাঁড়ালাম, টিকিট পেলাম পর্দার সামনের বেঞ্চীতে। সিনেমা দেখে তারপরের তিন দিন ঘাড় সোজা করতে পারি নাই।

সিনেমা শিল্পকে বাঁচাতে, সিনেমা হলে আগের মতো দর্শক ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ হিসেবে সরকার কিছুদিন আগে ভারতীয় ছবি আমদানির নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়ার উদ্যোগ নেয়। উল্লেখ্য, ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের সময় থেকে ভারতীয় ছবির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছিল। নেটিজেনরা সরকারের এ ধরনের সিদ্ধান্তের তীব্র সমালোচনা করেন।

ঢাকা নিউ মার্কেটের পাশে বলাকা সিনেমা হল। ছবি তুলেছে রাগিব হাসান, উইকিপিডিয়ার সৌজন্যে

আমরাবন্ধু ব্লগের একটি পোস্টে নজরুল ইসলাম মন্তব্য করেন:

হিন্দী সিনেমার প্রতি বিদ্বেষ থেকে না, দেশী একটা রুগ্ন শিল্পকে রক্ষা করতে আর নতুন উদ্যমে উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করার জন্যই সরকারকে এই হঠকারীমূলক সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতে হবে।

তবে আমদানির পক্ষে মত যে ছিল না, তা নয়। একজন ব্লগার যেমন বলেছেন:

প্রেক্ষাগৃহের বড় পর্দায় নানা দেশের নানা স্বাদের চলচ্চিত্র দেখার সুযোগ পাওয়া আমার কাছে একটি নাগরিক অধিকার। এই অধিকার কেবল ভারতীয় ছবি আমদানির কারণে চলচ্চিত্র-শিল্পের ধ্বংস বা উন্নয়নের বিতর্কে বন্দি থাকেনা।

সমালোচনার মুখে সরকার অবশ্য ভারতীয় সিনেমার ওপর থেকে আমদানির নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়ার সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করে নেয়।

এদিকে দেশীয় চলচ্চিত্রশিল্পের উন্নয়নের জন্য কী করা দরকার, তার একটি সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব দিয়েছেন কল্লোল মোস্তফা:

চলচ্চিত্র শিল্পের উন্নয়নের জন্য চাই রাষ্ট্রীয় প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ, আর্থিক দায়িত্ব নেয়া, চলচ্চিত্র শিক্ষার প্রাতিষ্ঠানিক ব্যাবস্থা এবং দেশের বড় বড় সিনেমা হলে বাধ্যতামূলক ভাবে মাসের অন্তত একটি সপ্তাহে ভারতীয় বাজারি ছবি নয় বরং ভারতসহ সারা দুনিয়ার সেরা চলচ্চিত্র প্রদর্শনের ব্যবস্থা করা।

1 টি মন্তব্য

আলোচনায় যোগ দিন

লেখকেরা, অনুগ্রহ করে লগ ইন »

নীতিমালা

  • অনুগ্রহ করে অপরের মন্তব্যকে শ্রদ্ধা করুন. যেসব মন্তব্যে গালাগালি, ঘৃণা, অবিবেচনা প্রসূত ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকবে সেগুলো প্রকাশের অনুমতি দেয়া হবে না .