বাংলাদেশ: আদিবাসীরা ভালো নেই

এই পোস্টটি আমাদের আদিবাসী অধিকার সংক্রান্ত বিশেষ কাভারেজের অংশবিশেষ

বাংলাদেশে ৪৫টিরও বেশি আদিবাসী সম্প্রদায় বসবাস করে। এর মধ্যে ১১টি বাস করে পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায়। বাকিরা উত্তরবঙ্গসহ দেশের অন্যান্য অঞ্চলে। এই আদিবাসীদের বেশিরভাগই ভালো নেই। তারা নানা বৈষম্য, নির্যাতন ও নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন প্রতিনিয়তই। কাপেং ফাউন্ডেশন ও অক্সফাম-এর ‘আদিবাসীদের মানবাধিকার পরিস্থিতি-২০১১’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত বছর ভূমিসংক্রান্ত সাম্প্রদায়িক সংঘাতের কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামে কমপক্ষে ১১১টি ঘরবাড়ি সম্পূর্ণভাবে জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে। লুটপাট করা হয়েছে ১২টি ঘরবাড়ি। এ ছাড়া ৭ আদিবাসীকে হত্যা করা হয়েছে। বিভিন্ন ঘটনায় গত বছর ৫ জন আদিবাসী নারীকে ধর্ষণের পর হত্যা এবং ১১ জন নারীকে ধর্ষণ করা হয়েছে।

এই প্রেক্ষিতে মিথুশিলাক মুরমু মন্তব্য করেছেন:

[…] বৃহত্তর সম্প্রদায়ের প্রতিবেশীরা যেন দিন দিন সাম্প্রদায়িকতা চিন্তা-চেতনাতেই উদ্বুদ্ধ হচ্ছে। স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অসাম্প্রদায়িক চেতনা, ধর্ম নিরপেক্ষতার ভাবমূর্তিতে ক্রমেই অশুভ কালির আঁচড় পড়তে শুরু করেছে। আদিবাসীরা প্রতিনিয়তই শঙ্কিত, আতঙ্কিতভাবে দিনাতিপাত করে চলেছে।

বাংলাদেশের আদিবাসী।

বাংলাদেশের আদিবাসী। ছবি আনোয়ার হোসেনের। সর্বস্বত্ত্ব ডেমোটিক্স।

মালবিকা টুডুবলেছেন:

আদিবাসী শিশুদের এখনো শিক্ষার প্রথম পাঠ নিতে হচ্ছে বাংলায়, যা তাদের মাতৃভাষা নয়। আর অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় যেন এই বিষয়ে কথা বলারও কেউ আর এই রাষ্ট্রে অবশিষ্ট নাই!

অজল দেওয়ান উচ্চশিক্ষার জন্য পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা শহরে এসেছেন। এখন পড়ছেন একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে। শহরে এসে নিজের জাতিসত্তা নিয়ে কী ধরনের সমস্যায় পড়েছেন আদিবাসী বাংলা ব্লগে সেটা নিয়ে লিখেছেন তিনি:

এই ক্ষুদ্র জীবনে অনেক অভিজ্ঞতা হয়েছে যার মধ্যে অধিকাংশই তিক্ত অভিজ্ঞতা। কিন্তু সবচেয়ে তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছে যখন শুধুমাত্র চেহারা ও ভাষা ভিন্নতার কারণে স্ল্যাং শুনতে হয়। হোটেলে খেতে গিয়ে শুনতে পাই হোটেল বয়ের মুখে ভ্যাংচানি; খোলামেলা রাস্তায় নিজস্ব ভাষায় গান গাইলেও একই অবস্থা। বাংলা গান কিংবা কবিতা বললে সমস্যা নেই; যত দোষ শুধুমাত্র নিজস্ব ভাষায়।

বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেও শান্তি নেই। ক্লাসমেটদের চোখে আমাদের বাস পাহাড়ে; সাপ, ব্যাঙখেকো মানুষের এক প্রজাতি। তেলাপোকা খাই কিনা, মাচাং ঘরে কিভাবে ঘুমাই প্রতিনিয়ত এই সব প্রশ্নের উত্তর দিতে হয়। […]

অজল দেওয়ানের মতো একই অভিজ্ঞতা আন্তনী রেমা‘র:

রাস্তায় চলতে ফিরতে শুনতে হয় ব্যাঙ্গাত্মক কথাবার্তা । বিশেষ করে আমরা যারা ফর্সা বর্ণের আদিবাসী, তারা সবচেয়ে বেশি এই সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছি । রাস্তাঘাটে, বাজারে আমাদের দেখলে অবোধ্য ভাষা (চ্যাং,চুং…) ব্যবহার করে আমাদের ব্যঙ্গ করা হয়, বিভ্রান্ত করা হয়, টিটকারী ঠাট্টামী করা হয়। তাঁদের এই ব্যবহার আমাদের মনে কতটুকু আঘাত দেয় তা কি ওরা জানে?

অজল দেওয়ান আর আন্তমী রেমার পোস্ট দুটি থেকে আদিবাসীদের নিপীড়ন যন্ত্রণার আঁচ পাওয়া যায়। এটা শুধু পাহাড়ি আদিবাসীদের জীবনে নয়, দেশের সকল আদিবাসী মানুষের জীবন-যাপনের পরতে পরতে এই ব্যথিত আর্তনাদ খুঁজে পাওয়া যাবে।

আদিবাসীদের জায়গা-জমি দখলের উদ্দেশ্যেই তাদের উপর নিপীড়ন চলে। দৈনিক কালের কণ্ঠের সাংবাদিক বিপ্লব রহমান উত্তরবঙ্গের আদিবাসী এলাকা ঘুরে এ বিষয়ে প্রতিবেদন লেখেন। সেখানে তিনি লিখেন:

সম্প্রতি দিনাজপুরের বীরগঞ্জ, চিরিরবন্দর, ফুলবাড়ী, নবাবগঞ্জ উপজেলার আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চল ঘুরে দেখা গেছে হত-দরিদ্র ভাষাগত সংখ্যালঘু সাঁওতালদের জমি কেড়ে নেওয়ার চিত্র। পুরো জেলার প্রায় পাঁচ লাখ আদিবাসী সাঁওতাল বহু বছর ধরে এমনিভাবে জমিজমা হারিয়ে নিঃস্ব হতে বসেছে।

এদিকে সিলেটের চা-বাগান এলাকা ঘুরে এসে সেখানকার আদিবাসী চা শ্রমিকদের মানবেতর অবস্থা তুলে ধরেন মিথুশিলাক মুরমু:

দিনভর চা-শ্রমিকদের হাড়ভাঙ্গা খাটুনির পর তাদের দৈনিক মজুরী সর্বোচ্চ ৩০ টাকা। কাকডাকা ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত নিরলস চায়ের কুঁড়ি তুলে বাঁশের তৈরী খাঁচিতে ভরে নিয়ে যায় ফ্যাক্টরিতে। […] চায়ের মূল্য দিন দিন বাড়লেও বাড়েনি তাদের মুজরি ও সুযোগ সুবিধা।

বৈষম্য, নির্যাতন ও নিপীড়নের শিকার হওয়া আদিবাসীদের ক্ষোভকে আরো উস্কে দেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দিপু মণি। তিনি বেশ কয়েকমাস আগে উন্নয়ন সহযোগী সংস্থার প্রতিনিধি এবং কূটনৈতিকদের এক বৈঠকে ‘দেশে আদিবাসী নেই’বলে মন্তব্য করেন। তার মতে, এদেশের পার্বত্য অঞ্চলে পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে বিভিন্ন উপজাতি বসতি স্থাপন করেছে কাজেই তাদের আদিবাসী বলা ঠিক হবে না। আদিবাসী সম্প্রদায় পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এই বক্তব্যের তীব্র প্রতিবাদ করেন। তারা সাংবিধানিক স্বীকৃতির দাবিতে রাজপথে নেমে আসে।

আদিবাসী হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতির দাবিতে ঢাকায় সমাবেশ করছেন আদিবাসী সম্প্রদায়। ছবি আবু আলা। স্বত্ব ডেমোটিক্স। ২৯ এপ্রিল, ২০১১।

মুক্তমনা ব্লগে অডঙ চাকমা ছবির মাধ্যমে দেখিয়েছেন যে কিভাবে ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আদিবাসীদের একটি পোস্টার থেকে smiling indigenous women of Chittagong Hill-Tract (পার্বত্য চট্টগ্রামের লাস্যময়ী আদিবাসী নারী) লেখার উপর সাদা পট্টি দিয়ে শুধুমাত্র women of Chittagong Hill-Tract (পার্বত্য চট্টগ্রামের নারী) করে দেয়া হয়েছে। এই ব্লগার বলেছে:

আদিবাসী শব্দ মুছে দিলেই কী আদিবাসীরা মুছে যাবে?

উল্লেখ্য, বাঙালি আর আদিবাসী সম্প্রদায় দীর্ঘদিন ধরে পাশাপাশি বসবাস করে আসলেও পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর ভারত থেকে আসা মুসলমানরা পার্বত্য চট্টগ্রামে বসতি স্থাপন শুরু করলে বৈরিতা শুরু হয় । আর ১৯৭৯ সালে সরকারী উদ্যোগে অবৈধভাবে প্রায় পাঁচ লক্ষ বাঙালী বসতি স্থাপনের মধ্য দিয়ে এই বৈরিতা প্রকট আকার ধারণ করে।

এই প্রেক্ষিতেই রামদাসচাঁদ হাঁসদা গভীর আক্ষেপ নিয়ে বলেন:

[…] শত বছর ধরে একই সঙ্গে বসবাস করেও আদিবাসী এবং বাঙালি একে অপরের বন্ধু হতে পারেনি।

আলোচনা শুরু করুন

লেখকেরা, অনুগ্রহ করে লগ ইন »

নীতিমালা

  • অনুগ্রহ করে অপরের মন্তব্যকে শ্রদ্ধা করুন. যেসব মন্তব্যে গালাগালি, ঘৃণা, অবিবেচনা প্রসূত ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকবে সেগুলো প্রকাশের অনুমতি দেয়া হবে না .