- Global Voices বাংলা ভার্সন - https://bn.globalvoices.org -

বাংলাদেশ: সাংবাদিক দম্পতি হত্যাকাণ্ডের কূলকিনারা হচ্ছে না

বিষয়বস্তু: দক্ষিণ এশিয়া, বাংলাদেশ, নাগরিক মাধ্যম, প্রচার মাধ্যম ও সাংবাদিকতা, প্রতিবাদ, বাক স্বাধীনতা, মানবাধিকার, সরকার

বাংলাদেশে সাম্প্রতিক একটি নৃশংস হত্যাকাণ্ড দেশজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে এবং সবার মুখে মুখে ফিরছে। গত ফেব্রুয়ারি মাসে ঢাকার নিজ ফ্ল্যাটে খুন হন সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরওয়ার এবং তার স্ত্রী মেহেরুন রুনি [1] [ইংরেজী]। তাদের ৫ বছরের ছেলে মেঘ, ঘুম থেকে উঠে তাদের মৃতদেহ দেখতে পায় এবং সে খুনীদের পূর্বে দেখেছে [2] [ইংরেজী]। সাগর সরওয়ার মাছরাঙা টেলিভিশনে বার্তা সম্পাদক পদে এবং মেহেরুন রুনি এটিএন বাংলার জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। গত ১৬ বছরে বাংলাদেশে ১৭ জন সাংবাদিক খুন হয়েছেন [3]। এখন পর্যন্ত কোনো হত্যাকাণ্ডেরই সুষ্ঠু বিচার হয়নি।

হত্যাকাণ্ডের এক মাস পেরিয়ে গেলেও এখনও প্রকৃত খুনীদের ধরতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এদিকে হত্যাকারীরা গ্রেফতার না হওয়ায় নানা ধরনের গুজব ডালপালা মেলেছে। সাংবাদিক এবং নাগরিক সমাজ সরকারের এই ব্যর্থতার নিন্দা জানিয়েছে। দেশজুড়ে এই খুনের সাথে দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে উপযুক্ত বিচারের দাবিতে ব্যাপক বিক্ষোভ, মানব-বন্ধন, প্রতিবাদ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে।

[4]

সাংবাদিক সাগর সরোয়ার ও মেহেরুন রুনির পরিবার। ছবি সিয়াম সরোয়ার জামিল। স্বত্ব ডেমোটিক্স (১২/২/২০১২)

ঘটনার এতোদিন পরেও ঠিক কী কারণে সাগর-রুনি খুন হলেন, তা এখনো জানা যায় নি। পত্রিকার রিপোর্টে পুলিশ বলেছে [5] যে প্রাথমিক তদন্তে মনে হচ্ছে, ঘটনা পরিকল্পিত এবং হত্যাকারীরা পূর্বপরিচিত।

সচলায়তন ব্লগের একটি পোস্টে [6] অরফিয়াস নামের একজন ব্লগার ঘটনা পরিকল্পিত বলে অভিমত দেন। তিনি বলেন:

ঘটনা দেখেছি, নিজেও কিছু লিঙ্ক দেখেছি, ঘটনা যতটুকু জানতে পারলাম, তাতে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, পূর্বপরিকল্পিত ভাবে প্রথমেই কোনো ভাবে বাসার ভেতরে অবস্থান নিয়েছিলো খুনিরা, আর গ্রীল কাটার পদ্ধতিটা অনেক পুরনো, অনেকগুলো চাঞ্চল্যকর খুনের ঘটনায় খুনিরা দৃষ্টি ঘোরানোর জন্য এই পদ্ধতি ব্যাবহার করেছে, আর বাসায় দুজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষকে খুন করা হলো কিন্তু কোনো অস্বাভাবিক শব্দ হলোনা কিংবা বাচ্চা ছেলেটি জেগে গেলনা এটা একটু গভীরভাবে পর্যবেক্ষণের দরকার, খুনি পূর্বপরিচিত না হলে এগুলো সম্ভব না।[…]

ব্লগার নৈষাদ খুনের ক্লু পেতে [6] নিহত সাংবাদিক দম্পতির ওই দিনের ফোন কল চেক করার কথা বলেন:

সাংবাদিক দম্পতির গত এক মাসের কললিস্টে যত নাম্বার আছে, সেই রাতে কতগুলি সক্রিয় ছিল এবং সেই বাসা অপারেটদের যে সব বিটিএসের অধিনে, সেই রাতে সেসব বিটিএসের থেকে কল করা হয়েছিল কিনা এভাবে এগোলে হয়ত গুরুত্বপূর্ন ক্লু পাওয়া যেতে পারে।

হত্যাকাণ্ডের পরদিনই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন ঘোষণা দেন ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে খুনীদের গ্রেফতারের। তবে প্রকৃত খুনীরা কেউই গ্রেফতার হয়নি এই সময়ের মধ্যে। এ নিয়ে নেট নাগরিকরা বেশ ক্ষোভ প্রকাশ করেন। আশিকওয়েবলগ [7] ৪৮ দিনেও গ্রেফতার হবে কি না সেটা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেন:

অত্যন্ত দুঃখের সাথে বলতে হচ্ছে যে প্রতিশ্রুতি দেয়া ৪৮ ঘন্টার সময়সীমা পার হয়ে গেছে অনেক আগেই। ৪৮ ঘন্টা কি ৪৮ দিন-এ গিয়ে দাঁড়াবে কিনা, এখন তার অপেক্ষা।

সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ড নিয়ে জনগণের ক্ষোভকে উসকে দেয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একটি বক্তব্য। তিনি একটি আলোচনা অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে বলেন, সরকারের পক্ষে কারো বেডরুম পাহারা দেয়া সম্ভব নয় [8]। প্রধানমন্ত্রীর এ বক্তব্যের প্রতিবাদ করে মর্তুজা খালেদ মিলটন বলেন [9]:

প্রধানমন্ত্রীর এমন মন্তব্য একেবারে অগ্রহণযোগ্য। আমি জোর দিয়েই বলছি, রাষ্ট্রের সবকিছু দেখভাল করার দায়িত্ব একমাত্র সরকারের। আর সরকার যদি তা নিশ্চিত করতে না পারে তাহলে বুঝতে হবে সে সরকার ব্যর্থ বা অযোগ্য।

একই রকম মন্তব্য করেন জাহাঙ্গীর আলম আকাশ [10]:

নিরাপত্তা কেবল বঙ্গভবন আর গণভবনের নয়, সারাদেশের সকল ভবন মানুষের নিরাপত্তা দেয়ার দায়িত্ব সরকারেরই।

সাগর-রুনির হত্যাকাণ্ড খুনীদের ধরার ব্যর্থতার প্রেক্ষিতে ব্লগে এবং ফেসবুকে একটি প্রচারপত্র ছড়িয়ে পড়েছে। এই প্রচারপত্রকে অনেকে সত্য বলে ধরে নিয়েছেন। আবার অনেকে এটিকে অপপ্রচার বলে মনে করছেন। “সরকারের ৪৮ ঘন্টা পেরিয়ে ১৩ দিনের ব্যর্থতাই, এমন প্রচারকে উস্কে দিচ্ছে” [11] বলে মন্তব্য করেছেন একজন ব্লগার।

তানবীরা খুনীদের ধরতে না পারার ব্যর্থতার সমালোচনা করে তদন্ত কাজে সফলতা পেতে বিদেশী বিশেষজ্ঞদের সহায়তা নেয়ার [12] পরামর্শ দেন:

অতীতেও অনেক ঘটনায় বিদেশী সাহায্য নেয়া হয়েছে। ভবিষ্যতেও তারা হয়তো অনেক ব্যাপার সমাধানের জন্য বিদেশী এক্সপার্টদের সাহায্য নিবেন, তাহলে এখন নয় কেন?

সারাদেশে সাংবাদিক ও্ নাগরিক সমাজ সাংবাদিক দম্পতির এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ জানিয়েছেন। [13]

সারাদেশে সাংবাদিক ও্ নাগরিক সমাজ সাংবাদিক দস্পতির এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ জানিয়েছেন। ছবি সিয়াম সরোয়ার জামিল। স্বত্ব ডেমোটিক্স (১২/২/২০১২)

বেসরকারী টিভি চ্যানেলগুলোর বাড়াবাড়ি নিয়েও অনেকে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। যেমন সাগর রুনির সন্তান মেঘকে ঘটনার দিন প্রশ্নবাণে জর্জরিত করে [14] বিভিন্ন টিভি চ্যানেলের সাংবাদিকরা। বর্তমানে প্রায় প্রতিদিনই এই বিষয়ে নানা প্রতিবেদন প্রকাশ হচ্ছে বিভিন্ন পত্রিকায়। এমতাবস্থায় এই হত্যাকাণ্ড নিয়ে আনুমানিক সংবাদ প্রকাশ বন্ধে আদালত ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ব্যবস্থা নিতে তথ্য সচিবকে নির্দেশ দিয়েছেন। সাংবাদিকরা এটাকে সংবাদপত্রের ওপর সেন্সরশিপ হিসেবেই ধরে নিয়ে এ ঘটনার প্রতিবাদ করেছেন [15]। প্রতিবাদ করেছেন নেটিজেনরাও। ফারজানা৯৯ সামহোয়ারইন ব্লগে [16] লিখেছেন:

আশার কথা হলো জনগণ, সাংবাদিক আর মিডিয়ার মুখ বন্ধ করা মাননীয় বিচারপতি এত সহজ নয়। […]। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রতিবাদ করছে মানুষ। এই প্রতিবাদ হেলায় উড়িয়ে দেবার মতো নয়।

এদিকে খুনীদের ধরতে উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য জার্মানীর বনে জাতিসংঘ অফিসের সামনে [17]মানববন্ধনের আয়োজন করা হয়েছে।

সাগর–রুনির হত্যাকাণ্ড আগামী নির্বাচনে প্রভাব ফেলতে পারে বলে মনে করেন ফকির ইলিয়াস [18]:

এটা খুবই দুঃখজনক, দেশের গোয়েন্দা সংস্থার সম্মিলিত প্রয়াস এখন পর্যন্ত সাগর-রুনির খুনিদের রাষ্ট্রের সামনে দাঁড় করাতে পারেনি। কেন পারেনি, এর জবাব রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রকদের দিতে হবে। তা না হলে গ্রহণযোগ্যতার প্রশ্ন দেখা দেবে আগামী নির্বাচনে। ক্ষমতাসীনরা এভাবে তাদের জনপ্রিয়তায় ধস নামুক, তা নিশ্চয়ই তারা চাইবেন না।

সাধারণ মানুষ এবং নিজের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন নিঝুম মজুমদার ‘সাগর-রুনির হত্যাকারীদের বিচার চাই’ [19] ফেসবুক পেজে মন্তব্য করেছেন:

যতটুকু ক্ষমতা রয়েছে ততটুকু ক্ষমতা দিয়ে এই হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু বিচার চেয়ে যাব। মেঘ [সাগর-রুনির সন্তান] ছেলেটির জন্য আমার বুকটি চৌচির হয়ে যায়। মেঘ এর জায়গায় তো হতে পারত আমার ছেলেটি,  রুনির জায়গায় তো হতে পারত আমার স্ত্রী, সাগরের জায়গায় তো হতে পারতাম আমি!!! কই যাব আমরা? কোথায় দাঁড়াব? কার কাছে যাব? এই বাঙলাদেশ কি চেয়েছি আমরা, এমন মৃত্যু উপত্যকা???