বাংলাদেশঃ জলবায়ুর পরিবর্তনে ক্ষুধা ও অপুষ্টির বৃদ্ধি

এই পোস্টটি পুলিৎজার সেন্টার/গ্লোবাল ভয়েসেস অনলাইন কর্তৃক খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা সিরিজের অংশ হিসেবে প্রকাশিত। এই প্রতিবেদনগুলি পুলিৎজার খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার পোর্টাল এবং এই বিষয়ে পৃথিবীব্যাপী ব্লগারদের আলোচনা উপর মাল্টিমিডিয়া রিপোটিং ভিত্তিতে তৈরি।

দক্ষিণ আফ্রিকার ডারবানে জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তনের সম্মেলনে (কপ১৭) জন্য সরকাররা প্রস্তুত হচ্ছে, যা আজ ২৮শে নভেম্বর শুরু হচ্ছে, বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন যে, জলবায়ুর পরিবর্তনের সর্ববৃহৎ প্রভাব উন্নয়নশীল দেশ যেমন বাংলাদেশ ক্ষুধা, অপুষ্টি এবং খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার অধিকতর ঝুঁকি সহ কৃষি খাত ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।

ক্ষুধা ও অপুষ্টি বৃদ্ধি পাচ্ছে

বন্যার কারণে বাংলাদেশী একজন কৃষক পুনরায় ধান লাগাচ্ছে। ছবি ফ্লিকার ব্যবহারকারী ইরি ইমেজেস এর সৌজন্যে (সিসি বাই ২.০)

বন্যার কারণে বাংলাদেশী একজন কৃষক পুনরায় ধান লাগাচ্ছে।

পূর্বাভাস বলছে যে, জলবায়ুর পরিবর্তনে কৃষি উৎপাদন কমে যেতে পারে ও খাদ্য-মূল্য বৃদ্ধি পাবে, ক্ষুধা ও অপুষ্টির ঝুঁকি বৃদ্ধি পাবে। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচীর প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ২০৫০ সাল পর্যন্ত জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণে ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা ১০-২০% বৃদ্ধি পাবে এবং ধারণা করা হচ্ছে, অপুষ্ট শিশুর সংখ্যা ২ কোটি ৪০ লক্ষ বৃদ্ধি পাবে-জলবায়ুর পরিবর্তনের প্রভাব ছাড়া ২১% বেশী।

আফ্রিকার সাব সাহারা এবং দক্ষিণ এশিয়া ও মধ্য আমেরিকার অংশ-বিশেষে বেশীরভাগ বৃদ্ধি ঘটবে বলে ধারণা করা হচ্ছে, যা মানচিত্রে বিস্তারিত। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, প্রাকৃতিক দুর্যোগের সংখ্যা ও তীক্ষ্ণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে, ভূমি ও পানির সংকট বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং আওতার বাইরে চলে যাচ্ছে এবং কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি ক্রমশঃ কঠিন হয়ে যাচ্ছে।

অ্যাকশন এইডের অক্টোবরে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুসারে, জলবায়ু সংক্রান্ত খাদ্য সংকটে কমপক্ষে ১০টি দেশ খুব অরক্ষিত অবস্থায় রয়েছে। সর্ব্বোচ্চ পাঁচটি অরক্ষিত দেশের মধ্যে গণপ্রজাতন্ত্রী কঙ্গো, বুরুন্ডি, দক্ষিণ আফ্রিকা এবং হাইতি সহ বাংলাদেশ রয়েছে। বেশীরভাগ ক্ষেত্রে উচ্চ ঘনত্বের জনসংখ্যা সহ নিম্নাঞ্চল ও দ্বীপ, নিম্ন চাষযোগ্য জমি এবং প্রায়শই প্রাকৃতিক দুর্যোগ এর কারণে বিশ্ব ব্যাংক ও এইড ডাটার ব্লগাররা বাংলাদেশকে “জলবায়ুর পরিবর্তন ও খাদ্য নিরাপত্তার আন্তক্রিয়ায় ’গ্রাউন্ড জিরো’” হিসাবে বর্ণনা করেছেন।

বাংলাদেশের প্রাইমেশিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক মির্জা গালিব দৈনিক ডেইলি ষ্টারে বিস্তারিত সম্ভাব্য প্রভাব সম্পর্কে বর্ণনা করেছেন:

বাংলাদেশে জলবায়ুর পরিবর্তনে সবচেয়ে বেশী প্রভাব সম্পর্কে গবেষকরা বর্ণনা করেছেন বন্যা, লবণাক্ততা বৃদ্ধি ও খরা, শস্য উৎপাদন ও খাদ্য নিরাপত্তায় সবগুলি ব্যাপকভাবে প্রভাব ফেলে। নদীর তীর ভাঙ্গন, সমুদ্রপৃষ্ঠের পানির উচ্চতা বৃদ্ধি এবং উপকূলীয় অঞ্চলে বিশুদ্ধ পানির অভাবের মুখোমুখি আমরা হয়ে থাকি। পূর্বাভাস হচ্ছে, বন্যা দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত দেশে ভয়াবহ বন্যা হবে; আমাদের দেশে খাদ্যাভাব রয়েছে যেখানে আমাদের অর্ধেক শিশুর যথেষ্ট পরিমাণ খাবার নেই; এবং বিশুদ্ধ পানির প্রাদুর্ভাব যেখানে পানি বাহিত রোগের কারণে মৃত্যুর হার ২৪%।

বাংলাদেশ ক্ষুধা দূরীকরণে এগিয়ে গেছে, জানুয়ারী, ২০১১ তে অপুষ্ট মানুষের সংখ্যা নেমে ২৭% হয়েছে এবং গত তিন দশকে বার্ষিক ধান উৎপাদন তিনগুণের বেশী বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু, যেহেতু কৃষি প্রধান অর্থনৈতিক শিল্প, বিশ্ব ব্যাংকের রিপোর্ট অনুসারে, বাংলাদেশের গড় অভ্যন্তরীণ উৎপাদন (জিডিপি) এর প্রায় ২০% যোগান দেয় এবং ৬৫% শ্রম শক্তি যুক্ত, জলবায়ুর পরিবর্তন এই অর্জনের জন্য হুমকি স্বরূপ।

ফার্মিং ফার্স্ট ব্লগে বর্ণিত হয়েছে:

জলবায়ুর পরিবর্তন ধানের উৎপাদন হ্রাস এর পূর্বাভাস দিচ্ছে, বাংলাদেশের প্রধান শস্য, এবং অন্য ফসল ও আমদানিকৃত খাদ্যশস্য এর উপর দেশের নির্ভরতা বৃদ্ধি পাবে। প্রত্যেক অঞ্চলে কমপক্ষে একটি ফসল এর শস্য উৎপাদন কমার সম্ভাবনা রয়েছে….জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে কৃষিতে জিডিপি প্রতিবছর ৩.১% কমার সম্ভাবনা রয়েছে।

কাজ করার আহবান

কৃষিতে জলবায়ুর প্রভাব প্রতিরোধে বাংলাদেশ সরকার বেশ কিছু উদ্যোগ যখন গ্রহণ করেছে, কৃষিতে জলবায়ুর পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় সাহায্য করার জন্য, অ্যাকশনএইড গরীব দেশের ক্ষুদ্র খামারে অধিক বিনিয়োগের, কৃষিকে জলবায়ু প্রতিরোধী করার জন্য প্রান্তিক চাষীদের অবিলম্বে ”নগদ জলবায়ু অর্থ” সরবরাহ করা, আঞ্চলিক খাদ্য মজুদের ব্যবস্থা করা, এবং ধনী দেশগুলোর কার্বন নির্গমনের মাত্রা কমানোর আহ্বান জানিয়েছে।

বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচীর হিসাব মতে গ্রীণ হাউজ গ্যাস নির্গমনের পরিমাণ কমানোর জন্য উল্লেখযোগ্য আন্তর্জাতিক কর্মসূচী জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্ষুধা বৃদ্ধির মাত্রা অর্ধেক কমাতে পারে।

বায়োফুয়েলের জন্য উন্নয়নশীল দেশে জমি দখল বন্ধ করা অ্যাকশনএইডের লক্ষ্য। সেপ্টেম্বরে ব্লগারদের সাথে গোলটেবিল বৈঠকে, উন্নয়নশীল দেশে চীন ও সৌদি আরবের মতো দেশের জমি ক্রয় ও লিজিং এর বিরোধিতা করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন, এটি দীর্ঘমেয়াদি টেকসই কৃষির ভিতকে দুর্বল করবে। পরিবর্তে, তিনি উন্নত খাদ্য নিরাপত্তা জন্য এবং উন্নয়নশীল দেশের নিজেদের কৃষিতে সামর্থ্য বৃদ্ধির সহায়তার লক্ষ্যে টেকসই খাদ্য মডেল প্রস্তাব করেন। অনুষ্ঠান পর্ব চলাকালীন তিনি বলেন:

আমেরিকা, কানাডা এবং ইউরোপের উদ্বৃত্ত খাদ্য উৎপাদনের ক্ষমতা রয়েছে এবং ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনা, পৃথিবীর একমাত্র জায়গা যার ২০ ফিট গভীর চাষযোগ্য জমি…., আমরা চীন, সৌদি আরব এবং অন্যান্যদের সুসম লাভের নিশ্চয়তায় কিন্তু অত্যধিক নয়, শস্যের জন্য দীর্ঘ মেয়াদি চুক্তির প্রস্তাব দিতে পারি, এবং অধিক মূল্যরোধ কিন্তু আফ্রিকা, ল্যাটিন আমেরিকা, দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় কৃষিকাজের বিনিয়োগের কারণে উচ্চমূল্য বজায় রাখতে হবে….তারা উপকৃত হবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত না এদেশগুলোর জন্য টেকসই কৃষি কাঠামো তৈরি করা যায়।

সামসুল ইসলাম এবং এম মিজানুর রহমান, বাংলাদেশ নিউ এজে প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে টেকসই কৃষির উল্লেখ করেছেন, যেহেতু কৃষি গ্রীণ হাউজ গ্যাসে উৎপাদনে ভূমিকা রাখে। বাংলাদেশের দি ফাইন্যানশিয়াল এক্সপ্রেস পত্রিকায় শহিদুল হক উল্লেখ করেছেন উচ্চ ফলনশীল বীজের। একই সঙ্গে খরা ও লবণাক্ত পরিবেশের উপযোগী জাতের প্রয়োজনীয়তাও উল্লেখ করেছেন। আর্থস্ক্যান ব্লগে গুডরান ফ্রীজ এর প্রশ্নোত্তর এ গবেষক উইনষ্টন ইউ বলেন বাংলাদেশে জলবায়ুর প্রভাব কমানোর জন্য বর্তমানের সমাধানসমূহ, যেমন, বন্যা ব্যবস্থাপনা অথবা নতুন ফসলের জাত, সৌভাগ্যবশত: ভবিষ্যৎে দেশের জন্যও মঙ্গল বয়ে আনবে

জলবায়ুর পরিবর্তন সম্পর্কে বাংলাদেশীদের সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে, একইসঙ্গে জলবায়ুর পরিবর্তন, জেন্ডার ও খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা সম্পর্কে তথ্য অবগত করানোর জন্য, দুটি গোষ্ঠী জলবায়ু পরিবর্তনের কাফেলা নিয়ে বর্তমানে সারা দেশে ভ্রমণ করছে।একশনএইডের মতে, আশা করা যায়, এই তথ্য পশ্চিমা দুনিয়া থেকে সমাধান পেতে সহায়তা করবে, যারা পৃথিবীর খাদ্য, পানি, শক্তি এবং কার্বন উন্নয়নশীল দেশের তুলনায় অধিক হারে ব্যবহার করে। উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের একজন নাগরিক বছরে গড়ে ২৬০ পাউন্ড মাংস খায়, যা একজন বাংলাদেশীর তুলনায় গড়ে ৪০ গুণ বেশী।

নাতাশা হায়দার, তার ব্লগে এই বৈষম্য সম্পর্কে উল্লেখ করেছেন:

বাংলাদেশ পৃথিবীর মধ্যে সর্বনিম্ন মাথাপিছু কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গমনকারীদের মধ্যে অন্যতম। নিম্ন নির্গমনের জন্য প্রধানত দুটি কারণ রয়েছে। প্রথমত: বাংলাদেশে ষ্টীল ও এলুমিনিয়াম উৎপাদনের মতো শক্তি নির্ভর কারখানা খুব বেশী নাই। দ্বিতীয়ত: প্রায় ৭০ ভাগ বাণিজ্যিক প্রাথমিক শক্তি প্রাকৃতিক গ্যাস থেকে আসে। সুতরাং, বিশ্ব উষ্ণায়নের সমাধান বেশীরভাগ ক্ষেত্রে তার নাগালের বাহিরে এবং যা উন্নত দেশের উপর নির্ভরশীল অথবা দ্রুত শিল্পায়নের জন্য,যা অধিকাংশ পশ্চিমে।

একইসঙ্গে, নাফিজা ইসলাম, সাউথ এশিয়ান জেনারেশন নেক্সট ব্লগে উল্লেখ করেছেন, বাংলাদেশ অনেক আগেই সমাধানের এক সৃষ্টিশীল উৎস:

যখন উন্নত দেশগুলো জলবায়ু পরিবর্তনের গতি বিপরীতমুখী করার জন্য অথবা তা সমাধানের জন্য মাথা চুলকচ্ছিল, বাংলাদেশ এ বিষয়ে ভালো অবস্থানে রয়েছে। লবণাক্ত জমিতে ধান জন্মানো থেকে শুরু করে ভ্রাম্যমাণ বাসা তৈরি, এ দেশের জনগণ সৃষ্টিশীল চিন্তার মাধ্যমে টিকে থাকতে সহায়তা করেছে। যা হোক না কেন, ভয়াবহভাবে আক্রান্ত এলাকা জলবায়ু পরিবর্তনের সমাধানের জন্য “চিন্তার আধার” হিসাবে কাজ করছে। বাংলাদেশ প্রকৃতির সমস্ত প্রতিকূলতা বেশ ভালোভাবে মোকাবেলা করেছে, বাশের মতো বেঁকেছে কিন্তু কখনো ভাঙ্গেনি।

আলোচনা শুরু করুন

লেখকেরা, অনুগ্রহ করে লগ ইন »

নীতিমালা

  • অনুগ্রহ করে অপরের মন্তব্যকে শ্রদ্ধা করুন. যেসব মন্তব্যে গালাগালি, ঘৃণা, অবিবেচনা প্রসূত ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকবে সেগুলো প্রকাশের অনুমতি দেয়া হবে না .