একটি বহুদলীয় গণতান্ত্রিক নির্বাচন, যা দেশটিকে একটি গণতান্ত্রিক সরকারকে দেশটির পথ প্রদর্শক হিসেবে বসিয়েছিল, তার ঠিক তিন বছর পর মালদ্বীপের এই শিশু গণতন্ত্র এখন নৈরাজ্য এবং বিশৃঙ্খলতার চূড়ান্ত পর্যায়ে এসে উপস্থিত হয়েছে। মালদ্বীপের গণতান্ত্রিক নিরীক্ষা অনিবার্যভাবে এখন এক ধবংসের মুখোমুখি, কারণ শাসক এবং বিরোধী দলের গুণ্ডারা দেশটির রাজধানী মালেতে পরস্পররে সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত [1] হয়েছে । তারা মানুষের সম্পত্তি লুঠপাট করে, ব্যক্তি মালিকানাধীন টিভি চ্যানেলগুলোতে আগুন দেয় এবং ইঁট ও পাথর নিয়ে একে অন্যের উপর হামলা চালায়।
পুলিশের একদল বিদ্রোহী কর্মকর্তা, সামরিক বাহিনী এবং পুলিশের মাঝে নোংরাভাবে অবস্থান গ্রহণ করে এবং সামরিক বাহিনীর কিছু সদস্য এই বিদ্রোহে পুলিশের সাথে যোগ দেয়। উত্তেজনা চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে, যখন রাষ্ট্রপতি পদত্যাগ করতে পারে, এমন এক বিভ্রান্তিকর সংবাদ সব জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে।
এ বছরের জানুয়ারী মাস থেকে দেশটির রাজনৈতিক সঙ্কট শুরু, যখন দেশটির সরকার পুলিশকে বিশেষ কয়েকজন বিরোধী দলের নেতার বিরুদ্ধে তদন্তের নির্দেশ প্রদান করে। সরকারের দাবী ক্রমেই ভিত্তিহীন বলে প্রমাণিত হয় এবং অভিযোগ ওঠে যে সরকার দেশটির ইসলামের প্রতি যে বিশ্বাস, সেটিকে হেয় করছে। সমালোচকরা বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে যখন পুলিশের গ্রেফতারের ঘটনা তুলে ধরে যে বিরোধী দলের উচ্চ পর্যায়ের নেতাদের বিরুদ্ধে তদন্ত করা হচ্ছে, অন্যদিকে বিরোধী দলের নেতাদের দাবী ছিল যে, তারা সরকারের এই ধরনের নিন্দার বিরুদ্ধে ।
এই প্রেক্ষাপটে মালদ্বীপের ক্ষমতাসীন মালদ্বীপ গণতান্ত্রিক দল (মালদিভিয়ান রুলিং পার্টি বা এমডিপি) একটি গণ প্রচারণা শুরু করে, যার নাম “থিয়েনেহ নুকিয়ানে [2]” [ দিবেহী ভাষায়], (যার অর্থ “আপনারা এমনটা বলতে পারেন না”)। এতে দাবী করা হয় যে ক্ষমতাসীন দল, দেশের বিরোধী দলকে আর তা করতে দেবে না, যা সরকারে কাছে ভিত্তিহীন অভিযোগ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
অতীতে কারো বিরুদ্ধে নিন্দা করা ছিল এক দণ্ডনীয় অপরাধ, এবং এতে লেখক বা ব্যক্তিকে কারাদণ্ড প্রদান করা হত, মূলত তা নিন্দা জানানোর মাত্রার উপর বিবেচনা করে আনা অভিযোগ, অথবা তারা যা প্রকাশ করেছে তার সমালোচনার ভিত্তিতে অপরাধীকে শাস্তি প্রদান করা হত। ২০০৯ সালে, নিন্দাকে অপরাধ নয় বলে গণ্য করা হয়, যা মালদ্বীপের মত প্রকাশের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে এক উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হিসেবে প্রশংসিত হয়। অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করে নিন্দা করার বিরুদ্ধে সরকারে তদন্তের নির্দেশ, মত প্রকাশের স্বাধীনতার প্রবক্তাদের জন্য এখন গভীর এক উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাড়িয়েছে।
যখন অপরাধ বিষয়ক আদালতের প্রধান বিচারপতি আবদুল্লাহ মোহাম্মদ, দেশটির দেবেহি কোয়ামি দলের (ডিপিকিউ) সহ সভাপতির গ্রেফতারকে অবৈধ বলে ঘোষণা করে [3] এবং পুলিশের হাতে আটক উক্ত নেতাকে ছেড়ে দেবার নির্দেশ দেয়, তখন পুলিশ, দেশটির জাতীয় প্রতিরক্ষা বাহিনী বা সামরিক বাহিনীকে অনুরোধ করে, তারা যেন বিচারপতিকে গ্রেফতার করে। ১৬ জানুয়ারি থেকে বিচারপতি মোহাম্মদ সামরিক বাহিনীর হাতে বন্দী রয়েছেন এবং জোর করে তাকে জনসম্মুখ থেকে অদৃশ্য করে ফেলার ঘটনায়, রাস্তায় বিক্ষোভের সূত্রপাত ঘটায় যা তিন সপ্তাহ ধরে চলছে।
এর আগে বিচারপতি মোহাম্মদ নিজেই বেশ কিছু বিতর্কের বিষয় হয়ে ছিলেন এবং বিচার বিভাগ সংক্রান্ত অধিদপ্তর (জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশন বা জেএসসি ) আবিষ্কার করে যে তিনি বিচারকের নীতিমালা ভঙ্গ করেছেন। জেএসসির এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে বিচারপতি মোহাম্মদ সাধারণ আদালতে (সিভিল কোর্টে) দরখাস্ত করে এবং আদালত জেএসসির বিরুদ্ধে এক আদেশ প্রদান করে যে, এই দরখাস্তের উপর রায় প্রদান না করা পর্যন্ত তারা যেন বিচারক মোহাম্মদের বিরুদ্ধে শৃঙ্খলাজনিত কোন ব্যবস্থা গ্রহণ না করে। ফৌজদারী আদালতের এই রায়টিও অত্যন্ত বিতর্কিত, কারণ বিচার বিভাগকে দায়িত্বশীল করার জন্য সংবিধান জেএসসি-কে যে ক্ষমতা প্রদান করেছে, এটি তার উপর হস্তক্ষেপ।
এরপর থেকে সরকার দাবী করে আসছে [4] যে বিচারপতি মোহাম্মদকে গ্রেফতার করার বিষয়টি, বিচারবিভাগকে নিষ্কলুষ করার যে সিদ্ধান্ত, এটি তার ক্ষেত্রে এক পদক্ষেপ।
বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দল উল্লেখ করেছে যে বিচারপতি মোহাম্মদকে যে সামরিক এক প্রশিক্ষণ শিবিরে আটকে রাখা হয়েছে তা আইনগতভাবে বৈধ নয় এবং সংবিধানের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন, সাধারণ নাগরিককে বন্দী করার সামরিক বাহিনীর কোন বৈধ অধিকার নেই। সরকার, বিচারক মোহাম্মদের বিরুদ্ধে এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে কোন অভিযোগ আনেনি। সামরিক বাহিনী দাবী করেছে যে তারা বিচারপতি মোহাম্মদকে একজন আইনজীবী প্রদান করেছে এবং মালদ্বীপের মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানকে তার সাথে সাক্ষাতের অনুমতি প্রদান করেছে। গ্রেফতারের পরের দিনই তার পরিবারকে জানানো হয়, বিচারপতি মোহাম্মদকে কোথায় রাখা হয়েছে।
বিচারক আবদুল্লাহ মোহাম্মদকে আটকে রাখার ঘটনায় বেশ কয়েকজন প্রখ্যাত আইনজীবী এর বিরুদ্ধে কথা বলেছে [5]। এদের মধ্যে রয়েছেন শাহিন হামিদ, যিনি সংসদীয় সংবিধান কমিটির সহ-সভাপতি, যে কমিটি বর্তমান খসড়া সংবিধান রচনা করেছে, রয়েছেন ধিয়ানা সাইদ, বর্তমান সরকারে প্রথম এটর্নী জেনারেল, আরো আছেন, হুসনু সুদ, যিনি বর্তমান সরকারের প্রাক্তন এটর্নী জেনারেল।
প্রসিকিটর-জেনারেল আহমেদ মুয়িজ্জু, যিনি উক্ত পদে যাবার আগে দেশটির অন্যতম ‘মামলা অনুশীলনকারী আইনজীবী’ হিসেবে খ্যাতি লাভ করেছিলেন, তিনিও এই আটকাদেশকে অবৈধ বলে উল্লেখ করেছেন। দেশটির প্রধান বিচারপতি আহমেদ ফাইজ উক্ত বিচারককে ছেড়ে দেবার আহ্বান জনিয়েছেন।
মালদ্বীপের মানবাধিকার কমিশনও এভাবে বিচারককে আটকে রাখার ঘটনায় তাদের উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। জাতিসংঘ, দেশটির সরকারের কাছে আহ্বান জানিয়েছে, হয় তারা বিচারককে ছেড়ে দেয় অথবা তার বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দায়ের করে। আব্বাস ফাইজ, যিনি এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল-এর দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক গবেষক, তিনি স্থানীয় মিনিভ্যান নিউজ ওয়েবসাইটে প্রকাশিত মন্তব্যে বলেন [6] যে, এ ভাবে বিচারককে আটকে রাখা অযৌক্তিক। এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, সরকারের প্রতি আহ্বান জনিয়েছেন, যেন সরকার তার বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ আনে, অথবা তাকে মুক্ত করে দেয়”। ফাইজ এই কথা গুলো লিখেছেন।
৬ ফেব্রুয়ারি তারিখের সন্ধ্যাবেলায়, উত্তেজনা চরমে পৌছে, যখন শাসক এবং বিরোধী দলের বিক্ষোভকারী পরস্পরের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়, যা এক উল্লেখযোগ্য সংঘর্ষে পরিণত হয়। ঠিক এরপরে কয়েকজন পুলিশ সংসদে শাসক দলের কক্ষে প্রবেশ করে এবং সেখানকার সম্পত্তি লুটপাট করে। একদল পুলিশ কর্মকর্তা, যারা তাদের ভাষায় অবৈধ আদেশের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে এবং প্রতিবাদে মধ্য রাতে মালের রিপাবলিকান স্কোয়ারে সমাবেত হয়।
মাঝরাতেও সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে, ভিটিভি [7] নামক টিভি চ্যানেল, যা কিনা বিরোধী দলের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিল এবং যার মালিক এক বিরোধী দলের নেতা, একদল গুণ্ডা এর অফিসে আগুন ধরিয়ে দেয়। হাভেরু ডেইলি নামের এক পত্রিকার সাংবাদিক আমিনাথ শিফলিন, এই বিক্ষোভের সংবাদ গ্রহণ করার সময় আহত হয়। গত কয়েক সপ্তাহে , বিক্ষোভ চলাকালীন সময়ে বেশ কয়েক জন সাংবাদিক আক্রমণের শিকার হয় এবং বেশ কয়েকটি ঘটনায় কিছু প্রচার মাধ্যমের অফিসে হামলা চালানোর ঘটনা ঘটে। এই সব বিক্ষোভের সময় সাধারণ নাগরিকদের সম্পত্তি ধ্বংস করার বিষয়টি ছিল এক সাধারণ ঘটনা, যা সারা মালদ্বীপে ছড়িয়ে পড়ে।
সকাল বেলায় বেশ কিছু নাগরিক সামাজিক প্রচার মাধ্যমে এখনো সক্রিয় থাকে, যারা এই অমীমাংসিত সঙ্কটের বিষয়ে তাদের মন্তব্য প্রদান করে যাচ্ছে। জুভানুজে মাইদাহান ( তরুণ্যের কেন্দ্র নামক এলাকা) [8] নামক ফেসবুকের এই পাতায় বিক্ষোভের বেশ কিছু ছবি প্রকাশ করা হয়েছে। এই ঘটনার উপর টুইটারে সব সময় তাজা সংবাদ প্রদান করা হচ্ছে।
প্রাক্তন এটর্নী জেনারেল হুসনু সুদ টুইট করেছেন [9] :
@এইচসুদঃ মনে হচ্ছে না, তারা এক রক্তাক্ত সংঘর্ষ এড়াতে পারবে। মালদ্বীপের জন্য এক বেদনাদায়ক দিন
নাত্তু টুইট করেছে: [10]
মালদ্বীপের জাতীয় প্রতিরক্ষা বাহিনী বনাম মালদ্বীপের পুলিশ বাহিনী #এমভিপ্রটেস্ট। জাতীয় প্রতিরক্ষা বাহিনী পিছু হটে গেছে।
ইউসুফ ওয়াহেদ জিজ্ঞেস করেছে: [11]
দেশটিতে ঘটছেটা কি! # মালদ্বীপে যে জটিলতা দেখা দিয়েছে তা এখন নোংরা রুপ ধারণ করেছে।
আলী তোহলাথ বলছে: [12]
@তোহলাথ:মালদ্বীপের জন্য এক বেদনাদায়ক দিন। এই উন্মাদনা বন্ধ করুন।
আলী সিয়ান টুইট করেছে: [13]
@ফালহো_ডি: যা ঘটছে তা দেখে মন খারাপ হয়ে যাচ্ছে, এতে কে জিততে যাচ্ছে? এবং মনে করি এটা খুব সাধারণ ভাবে ঘটতে পারত, আদতে মালদ্বীপের জন্য একটা বেদনাদায়ক দিন।
শারিফজিজ্ঞেস করেছে: [14]
@ শারিফ বিষয়টি আরো খারাপের দিকে গড়াচ্ছে, মালদ্বীপের সামরিক বাহিনী বনাম পুলিশ। কে জিতবে।
আগিসা জিজ্ঞেস করছে: [15]
@আগিসা: যখন আমি ঘুমাচ্ছিল, তখন #মালদ্বীপের ভাগ্যে কি ঘটেছে?
সফওয়াতুল্লাহ মোহাম্মদ টুইট করেছে: [16]
@সফওয়াত: আর কিছু বলার নেই। একে অন্যের প্রতি অভিযোগ, কোন সাহায্য প্রদান করবে না। পরম করুণাময় মালদ্বীপকে রক্ষা করুন। #এমভিপ্রটেস্ট।
এবং এখানে একটি তাজা সংবাদ রয়েছে: আহমেদ আফান শাফাই একটি ছবি সহ তা পোস্ট করেছে: [17]
মালদ্বীপের সামরিক বাহিনী পুলিশের সাথে যোগ দিয়েছে এবং জনতা দেশটির রাষ্ট্রপতি জনাব নাশিদের অসাংবিধানিক শাসনের বিরুদ্ধে।