বেশি দিন আগের কথা নয়। অ্যাঞ্জেলিনা জোলি তার প্রথম পরিচালিত ছবি ‘ইন দ্য লাইন অব ব্লাড অ্যান্ড হ্যানি’ নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে বসনিয়া এবং সার্বিয়ার মানুষরা কিভাবে নেয় সেটা নিয়ে বেশি চিন্তিত ছিলেন। একই সঙ্গে অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন স্থানীয় দর্শক যাদের তিনি তার যুদ্ধের ছবিতে তুলে ধরেছেন তারা কিভাবে নেয় এবং কিছু বিষয় নিয়ে তার যে ভয় ছিল, সেগুলো সত্যি হয়।
সার্বিয়ার পুলিশের সাথে বসনিয়ার এক নারীর প্রেমের কাহিনি নির্ভর যুদ্ধের গল্পটিকে বসনিয়ার দর্শকরা খুব ভালোভাবে নিলেও সার্বিয়ার মিডিয়া আমেরিকার এই অভিনেত্রীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঘোষণা করেছে। তার প্রতি ঘৃণা ছুঁড়ে দিচ্ছে।
সার্বিয়ার দৈনিক পত্রিকা কুরির সিরিজ লেখা (সার্ব ভাষায়) ছাপানোর উদ্যোগ নিয়েছে, যার মধ্যে দিয়ে সার্বিয়ায় জোলি’র সুনাম নষ্ট হচ্ছে:
অ্যাঞ্জেলিনা তার সিনেমায় দাবি করেছেন, বসনিয়ার যুদ্ধের ৩ লাখ মুসলিম মারা গেছেন, ৫০ হাজার মুসলিম নারী ধর্ষিত হয়েছেন। সার্ব রিপাবলিক যে গণহত্যার উদ্দেশ্যেই এটা করেছিল, তিনি জ্ঞাতসারেই সেটা খুঁজে দেখেছেন। এসব কিছুই সম্পাদন করা হয়েছিল চরম ইসলামিক নীতি দিয়ে। সিনেমায় সার্বদেরকে অপরাধী, খুনী, হত্যাকারী এবং ধর্ষক হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। আর মুসলমানদের ঘটনার শিকার হিসেবে দেখানো হয়েছে।
মুসলমানদের প্রতি জোলির পক্ষপাতের কারণ হিসেবে পত্রিকায় দাবি (সার্ব ভাষায়) করা হয়েছে যে, সিনেমায় সৌদি আরব টাকা বিনিয়োগ করেছে। আর এর পরিমাণ ১০ মিলিয়ন ডলার:
এটা সবাই জানেন যে, জোলি ওয়াশিংটনের রাজনীতিবিদদের খুব কাছের মানুষ। তিনি হয়তো মনে করেছিলেন জনগণ এটাকে আর্ট ফিল্ম হিসেবে চিন্তা করবে। কিন্তু এটা পুরোপুরি সার্ব বিরোধী প্রোপাগাণ্ডা। পরিচালক দর্শকদের এই বার্তা দিতে চেয়েছেন যে, সার্বরা হলো পাগলা কুত্তা। মুসলিমরা হলো নিরীহ শিকার।
মুসলিম উগ্রবাদীরা জোলির সিনেমায় টাকা ঢেলেছেন কুরির’র এই তথ্য সমর্থন করে সার্বিয়ার সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার সাবেক পরিচালক মমির স্টোনাজোভিক বলেন, “এটা সত্যের খুব কাছে।“
সার্বিয়ার পত্রিকারগুলোর নেতিবাচক প্রচারণা পড়েছে সিনেমার সবচেয়ে জনপ্রিয় রেটিং সাইট আইএমডিবি.কম এ। হাজার খানেক সার্বিয়াপ্রেমী নেতিবাচক ভোট করেছেন সেখানে। এতে করে সিনেমার স্কোর ৫.৪ থেকে নেমে ৩.৩ এ গেছে।
আইএমডিবি.কম এ জোলির সিনেমার পাতাটি খুব দ্রুতই সার্ব আর মুসলমানদের মধ্যে ভার্চুয়াল যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। (গত কয়েক দিনে যদিও পাঁচ পাতা বাদ দিয়েও এগারো পাতা মন্তব্য হয়েছে।)
সানজা_ক্যানকার বলেন:
কিভাবে আলোচনায় থাকা যায় অ্যাঞ্জেলিনা তা জানেন, যেমন: বিয়ে ভাঙ্গা, অন্যের স্বামী কেড়ে নেয়া, পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সন্তান দত্তক নেয়া। বরং তিনি “শান্তিদূত”-এর শ্লেষ পূর্ণ রাস্তা নিলেন যা তাকে রাজনীতিতে জড়িত করলেও এ সম্পর্কে তিনি কিছুই জানেন না। এবং তিনি একটা সিনেমা বানালেন, যা তাকে ঘৃণা দিয়েছে।
ভিটেজবার্গের পর্যবেক্ষণ:
সিনেমার পুরোটাই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে নির্মিত, মিথ্যা এবং ভুল তথ্যে ভরা। ৫০ হাজার মুসলিম মহিলা ধর্ষিত হওয়ার সংখ্যাটা নিশ্চিত নয়। এটা পরিচিত কেইস যখন সারাজেভোর ধর্ষিত নারীরা আফ্রিকান শিশু জন্ম দিয়েছিল। প্রকৃতপক্ষে জাতিসংঘের কর্মীরাই তাদের বাবা ছিল।
জনি এনটি উপসংহার টানেন:
চমৎকার কাজ দেখিয়েছো অ্যাঞ্জি। গোবেলস এবং হিটলার তোমাকে এবং তোমার সিনেমার মুগ্ধকর কাজ নিয়ে গর্ব করবে।[…]
রুডিডি২ জানতে চান:
এরকম ধ্বংসাত্মক পরিস্থিতি নিয়ে মানুষ সিনেমা (বিনোদন) বানানোর কথা চিন্তা করে কী করে? অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, টাকা অতি গুরুত্বপূর্ণ। […] শিল্পকে পুঁজি করে একজন তথাকথিত প্রযোজক হিসেবে অ্যাঞ্জেলিনা জোলি কী ভাবতে পারবেন, সেই নারকীয়, ভয়ার্ত, ধ্বংস, মৃত্যু আর হৃদয়বিদারক অবস্থা মধ্যে তার পরিবারকে কল্পনা করতে?
পিএসওয়াইএসডিথ্রি অ্যাঞ্জেলিনাকে তার নিজের লোকদের অপরাধের কথা স্মরণ করিয়ে দেন:
[…] আমেরিকার মাটিতে শুরুতে তারা আনুমানিক ১৫০০ জন এসেছিলেন। আর সেসময়ে স্থানীয় আমেরিকানদের সংখ্যা ছিল প্রায় ১২০০০০০০। ১৯৯০ সালে এসে এই সংখ্যা কমে গিয়ে দাঁড়ায় ২৩৭০০ জনে। […]
অ্যালেক্স-_মাইকেল লিখেন:
অ্যাঞ্জেলিনার কাছে আমি আরো বেশি কিছু আশা করেছিলাম। তিনি কালো চুলের অধিকারী। কিন্তু উজ্জ্বল চুলের কারো সাথে করতে গিয়ে তার সিনেমার চেহারা এমন হয়েছে। সার্বিয়ার নাজিদের দ্বারা কাউকেই কচুকাটা করতে বাধেনি। না শিশুদের, না ভালো মুসলিমদের। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, সেব্রিনিচার কথা বলা যায়, সেখানে সার্বরা স্বত:প্রণোদিত হয়েই করেছিল। কারণ সেব্রিনিচার চারপাশের কিছু সার্বিয়ান গ্রামে মুসলিমরা হামলা করে, সেখানকার জনগণকে উচ্ছেদ করেছিল। আর এর প্রতিশোধ নিতেই সার্বরা এটা করেছিল। নরওয়ের একটি তথ্যচিত্র সেব্রিনিচা শহরের বিশ্বাসঘাতকতা সম্পর্কে বিস্তারিত বলা হয়েছে।
বসনিয়ার মুসলিম অনলাইন কমিউনিটি সার্বদের মন্তব্য প্রত্যাখান করে এবং জোলির সিনেমাকে সমর্থন দেয়।
এফ_এস অ্যাঞ্জেলিনার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানায়:
[…] অপমানিত, নির্যাতিত নারীদের বক্তব্য তুলে আনার জন্য জোলিকে ধন্যবাদ। না বলা কথা আর অদেখা ঘটনার সাক্ষী হতে আমি সবাইকে সিনেমাটি দেখতে বলবো, বিশেষ করে সারাবিশ্বের নারীদেরকে। […]
সিবাক এর সাথে আরো যোগ করেন:
[…] আমরা বসনিয়ার মানুষরা ঘৃণা করতে জানি না। আমরা পৃথিবীর সবেচেয়ে শান্তিপ্রিয় জাতি। কেন যে যুদ্ধের ঘটনা এতো নিষ্ঠুর! আমরা বিশ্বাস করতে পারি নাই, এরকম ঘটনা ঘটতে পারে। আমরা বিশ্বাস করতে পারি নাই, আমাদের বন্ধুরা আমাদের বিরুদ্ধে দাঁড়াবে, আমাদের ধর্ষন করবে, আমাদের সন্তানদের হত্যা করবে, আমাদের বাড়িঘর কেড়ে নেবে। কিন্তু তারা সেটা করেছে। আমরা যারা বেঁচে আছি, তারা আমার মতো বিশ্বাস করে এবং বলে, সেখানে ভালো সার্বরাও ছিল। কিন্তু এখানকার মতো আরো অনেক মানুষকে যখন দেখি, যাদের সত্য সম্পর্কে ন্যূনতম ধারনা নেই, তারা অন্ধ, ঘৃণা প্রকাশকারী; আর এ কারণে এটা আমাকে বলে, তারা আবার সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তি করতে পারে। এটা আমার কাছে ভালো মনে হয়েছে, তারা তাদের আসল মুখ আমাদের দেখাচ্ছে। তারা কতটা অজ্ঞ সেটাও দেখাচ্ছে। […]
মেলা ফ্যাটকিক সিনেমার ফেসবুক পেজে জোলিকে ধন্যবাদ দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন:
অ্যাঞ্জেলিনা, সিনেমার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ জানাই। আমরা কেউই ভুলবো না এটা কি ছিল। ধন্যবাদ জানাই এই জন্য যে, যে সত্যের সাথে বেশিরভাগ মানুষ পুনর্মিত্রতা করতে পারবেন না, না দেখা পর্যন্ত যা বেশিরভাগ মানুষ বিশ্বাস করবে না…
দিনো গ্লিজিক তার এই মতামত সবার সাথে ভাগ করে নিয়েছেন:
সার্বরা যা করেছে, সেই সত্য বলার জন্য অ্যাঞ্জেলিনাকে ধন্যবাদ জানাই। সিনেমার চেয়েও এটা আরো বেশি বেদনাদায়ক ছিল।
ন্যাট তাসচিটি গার্সিয়া অ্যাঞ্জি অজ্ঞতা স্বীকার করে জিজ্ঞেস করেছেন:
আমি মাত্রই গ্র্যাজুয়েশন করেছি। আমি বসনিয়ার যুদ্ধ সম্পর্কে পড়িনি। উদ্বাস্তু শিবির সম্পর্কেও কিছু পড়া হয়নি। একজন মা এবং একজন সক্রিয় কর্মী হিসেবে আপনার কি মনে হয় না শিক্ষার মাঝে কিছু করা উচিত?
সার্বিয়ানদের হিংস্র প্রতিক্রিয়ায় উদ্বিগ্ন জোলি তার টুইটারে বলেছেন:
এটা কী করে সম্ভব যে একজন কাল্পনিক ব্যক্তির ইমেলের ওপর ভিত্তি করে বস্তাপচা @কুরিরভেস্টি সাময়িকীর বানানো গল্প পুরো জাতিই বিশ্বাস করে ফেললো?”
যদিও তার কয়েকদিন পরে এই টুইটটি বাতিল করা হয়। এবং সেখানে নতুন আরেকটা দেখা যায়:
অন্যদের ঘৃণার মাধ্যমে নিজের দেশ, গোষ্ঠী, ধর্মের প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করো না।
অন্যদিকে কুরির আক্রমণাক্ত ভঙ্গিতে লেখা প্রকাশ করে সফল হয়: সার্বরা অভিনেত্রীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামে: জোলির আক্রমণাত্মক টুইটের প্রতিক্রিয়ায় পত্রিকার অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে মন্তব্য প্রকাশিত হয়: অ্যাঞ্জেলিনা, তুমি জানো না তোমার জন্য কী অপেক্ষা করছে?
জোলি এই আবেদনও টুইট করে:
আপনি যা পড়ছেন, তার সবকিছুই বিশ্বাস করবেন না… তারা বাজে পত্রিকার জন্য উপকারি গাছ হত্যা করে।
জোলি স্লোবদনা ইভরোপার সাথে এক সাক্ষাত্কারে বসনিয়ার প্রতি তার মুগ্ধতা প্রকাশ করে বলেছেন: বসনিয়ার প্রেমে পড়া খুব সোজা।
আমি এই সিনেমা বানাতাম না যদি বসনিয়ানরা চিত্রনাট্যের সাথে একমত না হতো। আমি এটা পুড়িয়ে ফেলতাম…
পিঙ্ক টিভির মালিক জেলজেকো মিট্রোভিক সার্বিয়ার প্রভাব বিস্তারকারী লোকদের একজন। তিনি জোলিকে শুরুতেই বাতিল করে দেন সার্বিয়া বিরোধী সংস্কারের কারণে এবং সিনেমার প্রকল্প থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নিতে বলেন। যদিও এখন তিনি তার মত বদল করেছেন:
সিনেমা শেষ হওয়ায় এখন অ্যাঞ্জেলিনাকে আক্রমণ করা ঠিক হচ্ছে না। সিনেমা বানানো শুরু করার আগে আমরা কিছু পরিবর্তন করতে পারতাম। এখন বৈরিতা করা হবে শুধু শুধু। আর অতিরিক্ত বৈরিতা দিয়ে এখন কিছুই পরিবর্তন করা যাবে না। তাকে বেলগ্রেডে আমন্ত্রণ জানানো যায়। কারণ তার মতো মানুষ ভবিষ্যতে বর্হিবিশ্বে আমাদের ইমেজের উন্নতিতে সাহায্য করতে পারেন।