- Global Voices বাংলা ভার্সন - https://bn.globalvoices.org -

রাশিয়া: সোশ্যাল নেটওয়ার্ক সমাজকে একত্রিত করছে

বিষয়বস্তু: পূর্ব ও মধ্য ইউরোপ, রাশিয়া, প্রচার মাধ্যম ও সাংবাদিকতা, প্রযুক্তি, বাক স্বাধীনতা, সরকার

রাশিয়ায় মস্কো শহরের বলোতনেয়া স্কোয়ারে গত এক দশকের সর্ববৃহৎ বিক্ষোভ সমাবেশের [1] এক মাস পার হয়েছে। এই বিক্ষোভ সমাবেশে যেসব ব্লগার অংশ নিয়েছিলেন, এই ঘটনা নিয়ে তাদের লেখার কিছু নির্বাচিত অংশ [2], পরবর্তী পদক্ষেপ ও ভাবনা নিয়ে কিছু আলোচনা তুলে ধরা হলো।

রাশিয়ার সমাজে সোশ্যাল নেটওয়ার্কের প্রভাব নিয়ে এই লেখায় আলোকপাত করব। এটা বলা গুরুত্বপূর্ণ যে, সম্প্রতি ঘটে যাওয়া এই ঘটনাগুলোর সাথে প্রযুক্তিগত সম্পর্ক রয়েছে। এখানে আমি তুলে ধরব, সোশ্যাল নেটওয়ার্কের মাধ্যমগুলো বলোতনেয়া স্কোয়ারের এই বিক্ষোভ সমাবেশ আয়োজন ছাড়াও সমাবেশ চলাকালে এবং পরবর্তী ঘটনাগুলোর উপর কিভাবে প্রভাব ফেলেছিল।

ফেইসবুকের আবির্ভাব:

প্রথমত, রাশিয়ায় এই প্রথমবারের মতো ফেইসবুক সামাজিকভাবে একত্রিত করতে প্রধান মঞ্চ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। গত ক'বছর থেকে সোশ্যাল নেটওয়ার্কের মাধ্যমগুলো সামাজিক একত্রীকরণে হাতিয়ার হিসেবে কাজ করছে। ভিকনটাক্টে (রাশিয়ার সোশ্যাল নেটওয়ার্ক সাইট) আমাদের দেশে এ ধরণের প্রযুক্তির ক্ষেত্রে পথ প্রদর্শন করেছে,যখন টিভি চ্যানেল টু বাই টু'র দর্শকরা প্রতিবাদ করতে পথে পথে নেমেছিলেন, তখন এই চ্যানেলের নিবন্ধন বাতিল হওয়ার সম্ভাব্য আশঙ্কা দেখা যায়।

রাশিয়ায় সামাজিকভাবে একত্রীকরণের আরেকটি মঞ্চ হিসেবে লাইভ জার্নাল (উদাহরণস্বরুপ, এটি ব্লু  বাকেট [3] আন্দোলনের মূল হোতা) ভূমিকা পালন করে। ফেইসবুক অবশ্য ২০১১ সালের ডিসেম্বরের আগে এ ক্ষেত্রে তেমন কোন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেনি।

২০১১ সালের ডিসেম্বরের ১০ তারিখে মূল বিক্ষোভ সমাবেশের আয়োজন করা হয় বিপ্লব স্কোয়ারে। এর পরিকল্পনা হয়েছিল রাশিয়ার বামপন্হী [4] নেতা সার্গেই উদাতসভ, তার স্ত্রী আনাস্তাসিয়া ও মস্কো সলিডারনস্তের প্রতিনিধি নেদযাহদ মিতযুস্কানিয়ার উদ্যোগে। আশ্চর্যজনকভাবে, মস্কো কর্তৃপক্ষ এ সমাবেশে তিন শত ব্যক্তিকে অংশ নেওয়ার অনুমতি দেন।

এই বিক্ষোভ সমাবেশের আয়োজন নিয়ে কথাবার্তা শুরু হয় ডিসেম্বরের ৬ তারিখে, যখন এর আগের দিন চিশতি প্রুডিতে অন্য একটি সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয় এবং বেশ ক'জন গ্রেফতারও হন। সেই বিক্ষোভ সমাবেশটি এতো বিশালভাবে ও এতটা উত্তেজনা ও তিক্ততায় শেষ হবে তা তখনও কেউ আশা করেনি। আলেক্সি সিদোরেনকো এ নিয়ে বিস্তারিতভাবে লেখেন “নেট ছুঁচোদের বিপ্লব [5]” শীর্ষক লেখায়।

ডিসেম্বরের ৬-এ নাগরিকদের এক বিশাল দল শহরের বিজয় স্কোয়ারে পক্ষপাতমূলক নির্বাচনের প্রতিবাদে আবারও সমবেত হন যা সাম্প্রতিক কালে পুটিন শাসনের বিরুদ্ধে একটি প্রতীকী আয়োজন হিসেবে দেখা হয়। এই সমাবেশ ভাঙ্গতে পুলিশ দমন অভিযান শুরু করে এবং বহু বিক্ষোভকারীকে গ্রেফতার করে।

ডিসেম্বরের ৬ তারিখে অনুষ্ঠিত বিজয় স্কোয়ারের বিক্ষোভের বিরুদ্ধে পুলিশী অভিযানে পর পরই বিপ্লব (রেভলিউশন) স্কোয়ারে আরেকটি বিক্ষোভ সমাবেশে যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়ে ফেইসবুকে একটি গ্রুপ [6] আত্মপ্রকাশ করে । মজার ব্যাপার হচ্ছে,এই গ্রুপের জন্ম হয় ইলিয়া ক্লিশিন নামের একজন ব্লগারের মাধ্যমে যার সাথে রাজনৈতিক দল বা গোষ্ঠীর কোন রকম সম্পর্ক নেই। ইলিয়া হচ্ছেন “এপিক হিরো [7]” নামের অন-লাইন রিসোর্সের প্রধান যা মূলত: হিপস্টার্স বা শহুরে তরুণদের ফ্যাশন সম্পর্কিত একটি প্রকাশনা।

ফেইসবুকের এই নতুন গ্রুপটি বিক্ষোভ সমাবেশের সপক্ষে দ্রুত জনপ্রিয়তা লাভ করতে থাকে। মাত্র চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে ডিসেম্বরের ৮ তারিখে এটি প্রায় পঁচিশ হাজার সমর্থক জোগাড় করে যারা নিরপেক্ষ একটি নির্বাচনের সপক্ষে বিক্ষোভে অংশগ্রহণের আগ্রহ প্রকাশ করেন। এছাড়াও, প্রায় আট হাজার স্বাক্ষরকারী তাদের ফেইসবুক স্ট্যাটাসে যোগ করেন: “বিক্ষোভ সমাবেশে অংশ গ্রহণে আগ্রহী”।

ঠিক একই ধরণের গ্রুপ [8] ভিকনটাক্টের সাইটে আত্মপ্রকাশ করে সেখানে বার হাজারের চেয়েও বেশী আগ্রহী বিক্ষোভ সমাবেশে অংশগ্রহণের পক্ষে স্বাক্ষর করেন।

সংখ্যায় আসন্ন বিক্ষোভ সমাবেশ:

ডিসেম্বরের ১০ তারিখে অনুষ্ঠিত বিক্ষোভ সমাবেশের দিন পর্যন্ত, প্রায় চল্লিশ হাজার মানুষ এতে অংশ গ্রহণের আগ্রহ প্রকাশ করেন। আমার মতে, দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণটি হচ্ছে, বিক্ষোভে অংশগ্রহণে আগ্রহীদের সংখ্যাতাত্ত্বিক এই বিস্ফোরণ সোশ্যাল নেটওয়ার্কের গন্ডি অতিক্রম করে। সত্যি সত্যি এরা অংশ গ্রহণ করবে প্রতীয়মান হয়েছে বলেই কর্তৃপক্ষ শেষ অবধি সমঝোতায় আসতে বাধ্য হন, এটি কোন ছাড় দেওয়া ছিল না।

এর আগে কেউ জানতেন না, কতো মানুষ এ ধরণের বিক্ষোভ সমাবেশে যোগ দিবেন। ভিন্ন মতাবলম্বীদের প্রথম গণ বিক্ষোভের সাফল্য দেখা যায় ২০০৭ সালে সেইন্ট পিটার্সবার্গের সমাবেশে। এতে অংশগ্রহণকারীদের বিশাল সংখ্যা শুধু কর্তৃপক্ষ নয় আয়োজকদের কাছেও অপ্রত্যাশিত ছিল।

এখন, সোশ্যাল নেটওয়ার্কের সুবাদে আমরা জানতে পারি বিক্ষোভ সমাবেশে অংশগ্রহণে আগ্রহীদের প্রকৃত সংখ্যা যা প্রতিদিন ঘন্টার কাঁটা ধরে বৃদ্ধি পাচ্ছিল। এক্ষেত্রে, এই সংখ্যার শক্তি অনুধাবন করতে হবে। ফেইসবুক ও ভিকনটাক্টের সাইটে ক্রমবর্ধিত এ সংখ্যাগুলো কোন ব্যক্তি দ্বারা বা বিশেষ পদ্ধতিতে উদ্দেশ্যমূলকভাবে বদলানো সম্ভব নয়। এই বিক্ষোভ সমাবেশ প্রকৃতভাবে গণমানুষের রায় প্রতিফলনের ক্ষমতা রাখে।

অবশ্যই সরকার এই সম্ভাব্য বিক্ষোভকারীদের সংখ্যায় আতঙ্ক বোধ করেছিল। তারা আয়োজকদের ক্রেমলিন ও সরকারী ভবনগুলোর কেন্দ্র থেকে একটু দূরে সরিয়ে বিক্ষোভ সমাবেশ করতে বাধ্য করে। এছাড়াও সরকার চাচ্ছিল বিক্ষোভ সমাবেশ যাতে শান্তিপূর্ণভাবে অনুষ্ঠিত হয় রেভ্যুলুশন স্কোয়ার থেকে বলোতনেয়া স্কোয়ারে ইতিমধ্যে অনুষ্ঠিত সমাবেশগুলোর ধারাবাহিকতায়।

ফেইসবুকে নিবন্ধিত বিক্ষোভকারীদের সম্ভাব্য সংখ্যা থেকে সত্যিকারের সংখ্যা অনুমান করা গেছে যা কর্তৃপক্ষকে তাদের অবস্থান বদলাতে বাধ্য করে। বহু অংশগ্রহণকারী অহেতুক পুলিশের ব্যাটন চার্জ থেকে নিষ্কৃতি পেলেন। রাশিয়ায় আগামীর দিনগুলোর জন্য এই দৃষ্টান্ত মোটেও খারাপ নয়।

ইন্টারনেট অনুপ্রাণিত শ্লোগান:

তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, এই প্রথমবারের মতো গণবিক্ষোভে আসা মানুষগুলো তাদের শ্লোগানের ভাষা নিয়ে এসেছিলেন ইন্টারনেট থেকে। ঘটনাচক্রে, লাইভ জার্নাল ইতিমধ্যে প্রতিবাদের একটা দৃষ্টিভঙ্গী নির্মাণ করে রেখেছিল। স্কোয়ারে আমরা দেখতে পাই বিক্ষোভকারীদের হাতের প্ল্যাকার্ডের শ্লোগানগুলো শোভিত হয় লাইভ জার্নালে প্রকাশিত শ্লোগান অনুসরণ করে।

বিশেষভাবে,এই প্ল্যাকার্ডে [9] “গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন” লক্ষ্যণীয় যা ইউনাটেড রাশিয়া পার্টির সমর্থনে ভোট কারচুপির সংখ্যাতাত্ত্বিক প্রমাণপঞ্জী।

বলোতনেয়া স্কোয়ারে “গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন” প্ল্যাকার্ডে লেখা আছে: “আমরা বিশ্বাস করি গ্যাসে”।

রাশিয়ান ব্লগাররা সরকারের নির্বাচনী উপাত্ত বিশ্লেষণ করে ডিসেম্বর ৪ তারিখের নির্বাচনের ভোটের শতকরা হার বিশ্লেষণ করেন। এই বিশ্লেষণের ফলাফল মাকসিম সেনিচিকভের লাইভ জার্নালে প্রকাশিত [10] হয়। এটা স্পস্ট ছিল যে, ডিসেম্বরের ১০ তারিখের আগে খুব অল্প সংখ্যক মানুষ গ্যাস ও তার তত্ত্ব সম্পর্কে জানতেন। কিন্তু ডিসেম্বরের ১০-এ সবার হাতে শোভিত হয় গ্যাসের কথা।

এছাড়া, প্রধান নির্বাচন কমিশনার চুরভ একজন যাদুকর বলে ঘরে বানানো প্ল্যাকার্ডগুলোর জনপ্রিয়তার শীর্ষে স্থান করে নেয়। রাষ্ট্রপ্রধান মেডভেডভ সুন্দরভাবে নির্বাচন সম্পন্ন করার জন্য নির্বাচন কমিশনার চুরভকে “যাদুকর” বলে আখ্যায়িত করেন। কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশনের প্রধান বিনীতভাবে এর প্রত্যুত্তরে বলেন,‍”আমি যাদুকর নই, আমি কেবল শিখছি”।


“যাদুকর, আমার ভোট গেল কোথায়?” বলোতনেয়া স্কোয়ারে এক ব্যানারের লেখা।

গ্যাজেটের মাধ্যমে প্রতিবাদ:

চতুর্থ পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, এই সাম্প্রতিক বিক্ষোভ সমাবেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারী যারা আধুনিক সংবাদ মাধ্যম ও মোবাইল ডিভাইস ব্যবহার করেন তারা এতে দৃশ্যত সক্রিয় ছিলেন।

যদিও বিক্ষোভে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে কি সংখ্যক স্মার্টফোন ছিল তা জানা না গেলেও প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে স্মার্টফোনের ব্যবহার ছিল সর্বোচ্চ। তথ্য বিশ্লেষক দল স্মার্ট মার্কেটিং-এর জরিপে [11] অবশ্য এ তথ্য বেরিয়ে এসেছে। এই জরিপ অনুসারে, বলোতনেয়া স্কোয়ারে ডিসেম্বরের ১০ তারিখে সমাবেশে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে আপেলের মোবাইল ফোনের ব্যবহার ছিল সবচেয়ে বেশী: আইফোন ও আইপ্যাড গেজেটের অংশ ছিল ৪৬.৬%।

এটা বেশ লক্ষ্যণীয় যে, বিক্ষোভে অংশগ্রহণকারীদের মোবাইল ফোন বা ডিভাইসগুলো শুধু যে চলমান বিক্ষোভ সমাবেশের তথ্য ইন্টারনেটে প্রচার করেছে তা-ই নয়, বরং প্রচার অভিযান ও শ্লোগানগুলোর মাধ্যমও [12] ছিল।

এর পরবর্তী বিক্ষোভ সমাবেশ ডিসেম্বরের ২৪ -এ মস্কোর শাখারভ প্রসপেক্টে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। এর আয়োজনে ফেইসবুক সাংগঠনিক এক শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে । ১৯ ডিসেম্বরের সন্ধ্যা পর্যন্ত, তিরিশ হাজার বিক্ষোভকারী অংশগ্রহণ করার কথা জানিয়েছেন।