- Global Voices বাংলা ভার্সন - https://bn.globalvoices.org -

বাংলাদেশ: যৌতুকের বিরুদ্ধে এক সাহসী পদক্ষেপ

বিষয়বস্তু: দক্ষিণ এশিয়া, বাংলাদেশ, নাগরিক মাধ্যম, প্রতিবাদ, মানবাধিকার, লিঙ্গ ও নারী

বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে শত শত বছর ধরে যৌতুক [1] সামাজিক একটি প্রথার অংশ হিসেবে বিবেচিত হয়ে এসেছে এবং অনেক উন্নয়নশীল দেশে এই বিষয়টিকে কনের পরিবারে জন্য একটি অর্থনৈতিক চাপের কারণ হিসেবে দেখা হয়। গত শতকে দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশে আইনের মাধ্যমে যৌতুক গ্রহণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে, কিন্তু তারপরে অবৈধ ভাবে এবং ব্যাপক হারে যৌতুক গ্রহণ করা হচ্ছে।

প্রতি বছরই আমরা যৌতুক সংক্রান্ত ঘরোয়া নির্যাতনের খবর পেয়ে থাকি, কিছু কিছু ক্ষেত্রে যা প্রায়শ: স্বামীর দ্বারা স্ত্রী হত্যার মধ্যে দিয়ে শেষ হয়। যৌতুক বিষয়ে সাম্প্রতিক এক প্রতিবাদ বাংলাদেশের সামাজিক প্রচার মাধ্যম আলোচিত এবং আলোড়িত হয়েছে।

কনে ফারজানা ইয়াসমিন ১১/১১/১১ এর বিশেষ তারিখটাকে তার স্বপ্নের বিয়ের তারিখ হিসেবে নির্বাচিত করেছিল। ফারজানা এক বীমা কোম্পানীতে কাজ করে। তার হবু বর শওকত আলি খান হিরণ একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের হেডমাস্টার। গত শুক্রবার [2] ঠিক সময়ে বিয়ের আনুষ্ঠনিকতা শুরু হয়। কিন্তু সম্বর্ধনার সময় ফারজানার ফুপু শ্বাশুড়ি, কনের পরিবারে কাছে টেলিভিশন, ফ্রিজ, মোটর সাইকেল সহ [3] এবং আরো কিছু উপহার দাবী করে। বিয়েতে উপস্থিত অতিথিদের সামনে তারা তাদের এই দাবী পেশ করে।

বিস্মিত কনে আবিষ্কার করে যে তার সদ্য বিবাহিত স্বামী এই যৌতুকের দাবীর পক্ষে কথা বলছে [4] এবং বিয়ের আসরে তার স্বামীকে তালাক দিয়ে ফারজানা সারা দেশের সবাইকে এক বার্তা প্রদান করে। রাত পর্যন্ত কনের আত্মীয়রা এই সমস্যার সমাধান করার চেষ্টা করে, কিন্তু ফারজানা তার সিদ্ধান্তে অটল থাকে।

এই ঘটনার পর বর পরে তার ফেসবুকের স্ট্যাটাসে [5] লেখে, “ঘটনা হচ্ছে আমার বিয়ে ভেঙ্গে গেছে” এবং সে এর জন্য অতিথিদের কাছে ক্ষমা চেয়েছে। সাথে সাথে বর দাবী করে যে, সে কোন যৌতুক দাবী করেনি। এরপর সে কনের বিরুদ্ধে ফেসবুকে এক নোংরা প্রচারণা শুরু করে [6] [বাংলা ভাষায়]। সব জায়গা থেকে নেট নাগরিকরা এর প্রতিবাদ করে এবং এরপর তার ঘৃণা ছড়ানো পোস্ট অপসারণ করা হয়।

ফারজানা ব্যাখ্যা দিয়েছেন [7]:

যৌতুক সমাজের একটা ক্যান্সারে পরিণত হয়েছে। আমি সংবাদের পাতায় এই সংক্রান্ত সংবাদ পড়তাম আর সব সময় ভাবতাম, কেন এমনটা ঘটে। […] কিন্তু যখন তা আমার আমার চোখের সামনে ঘটতে শুরু করল…আমার ভেতরে যেন কিছু একটা ঘটল। আমি অনুভব করলাম এর বিরুদ্ধে আমার কথা বলা এবং কিছু করা উচিত[…]। হয়ত আমি আর দশটা মানুষের জীবন বদলে দিতে পারি না, কিন্তু আমি মানুষকে এই শিক্ষা দিতে চাই যে মেয়েরাও কিছু করতে পারে।

সে প্রশ্ন তুলেছে, তার মত শিক্ষিত মেয়েরা যদি এই ধরনের সিদ্ধান্ত না নিতে পারে, তাহলে কে তা পারবে?

এখানে তার সাক্ষাৎকারের এক ভিডিও রয়েছে [4] [বাংলা ভাষায়], যা ফারজানা স্থানীয় এক পত্রিকাকে প্রদান করেছিল। ( এটি আপলোড করেছে প্রিয়চ্যানেল [8]) ।

আনহার্ড ভয়েস নামক ব্লগ এই সাক্ষাৎকারের ইংরেজী অনুবাদ করেছে [9]

যদি আমি তালাক দেই তাহলে কি হবে? আমার এখানে থাকার আর প্রয়োজন নেই। বিয়ে দরকার নাই আমার। আমি আমার মত থাকব। আমি এমন এক মানুষের সাথে ঘর করতে চাই না……মেয়েরা ভাব, তারা মনে করে যে একবার বিয়ে হয়ে গেলে, আর সে ঘর ছেড়ে যেতে পারবে না। তারা এমন এক মন্তব্য করেছে, কি ভাবে সে তালাক দিতে পারল। কেন আমি জাহান্নামের ভেতর থাকব জেনেশুনে, … আমরা বলি খারাপ দিক, কিন্তু তারপরেও তা অহরহ হচ্ছে। কিন্তু আমি এর প্রতিবাদ করতে না পারলে অন্য পাঁচটা মেয়েতো মারবে না…… আমরা সবাই সভা, সমাবেশ করি, মিছিল মিটিং করি, কিন্তু পুরুষ শাসিত সমাজে ওটা রয়ে গেছে। সে ক্ষেত্রে টিচাররা যদি এই কাজটা করে তাহলে সমাজ কি শিখবে তাদের কাছ থেকে। টিচাররা কিন্তু দশটা মানুষকে শিক্ষা দেয়। সে এক সরকারি টিচার। এবং সরকার সব সময় যৌতুকের বিরুদ্ধে কথা বলে। এই সমস্ত লোকদের অবশ্যই শাস্তি দেওয়া উচিত। সামাজিক ভাবে তাদের বহিষ্কার করা উচিত। আমি গর্বের সাথে বলতে পারি যে ওই মুহূর্তে আমি বউ সাজে বসে আছি শ্বশুরবাড়ি যাব বলে, সেখান থেকে আমি ব্যাক করলাম।

[10]

ফারজানা সাক্ষাৎকার প্রদান করছে। ছবি কৌশিকের সৌজন্যে।

সাক্ষাৎকার গ্রহণের সময় কৌশিক ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিল এবং সে এই বিষয়ে বিডিনিউজ২৪.কম ব্লগে লিখেছে [10] [বাংলায়]:

তার যুগান্তকারী ঘটনা শুনছি। ফারজানাকে দেখে সজাগ হতে হয়। এমন সাহসী সিদ্ধান্ত ক’জন নিতে পেরেছেন? যৌতুকের দাবী মেটাতে গিয়ে নির্যাতনের শিকারের ঘটনা আমরা অহরহ শুনি। কিন্তু এভাবে ঘুরে দাঁড়াবার দৃষ্টান্ত বিরল।

কৌশিকের পোস্টে অনেকে মন্তব্য করেছেন। গিয়াসউদ্দিন ভুঁইয়া ফারজানাকে অভিনন্দন জানিয়েছেন এবং বলছেন:

তিনি যে এই সাহসী পদক্ষেপটি নিয়েছেন তা প্রতিটি ঘরে ঘরে প্রতিটি মানুষের মনে রাখা উচিত এবং সকলের জীবনে তার প্রতিফলন ঘটানো উচিত। শুধু তাকে বাহবা দিলেই দায়িত্ব শেষ হবে না।

পঙ্কজ চৌধুরী বলেছেন:

ফারজানা তোমাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ। তুমি দেখিয়ে দিয়েছ মেয়েরা বাজারের পণ্য নয়। মেয়েরাও মানুষ তাদেরও স্বাধীনতা আছে।

এই বিষয়ে ইংরেজী দৈনিক দি ডেইলি স্টারের এক প্রবন্ধে মুক্তাদির এস হোসাইন মন্তব্য করেছেন:

এটা কেবল শুরু। যে সমস্ত ভিক্ষুক যৌতুকের লোভ করে, তাদের জন্য এটা একটা সতর্ক বার্তা।

মনজের.এইচ. সরকার লিখেছেন:

এই মেয়েটার শক্ত অবস্থান এবং সাহস আর আমাদের এই উপমহাদেশে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে চলে আসা এই অর্থহীন ঐতিহ্য বা অনুশীলনের প্রতি অনঢ় প্রত্যাখ্যানের সিদ্ধান্তের প্রতি আমার শ্রদ্ধা রইল। সে পুরোপুরি উপলব্ধি করেছে যে এটা কি ধরনের বিবাহ হতে যাচ্ছে। পরস্পরের আস্থা এবং ভালবাসা দিয়ে তৈরি হওয়া বিয়ের মত এক পবিত্র বন্ধনের বদলে একে একটা বিক্রয় চুক্তির মত মনে হচ্ছিল।

বাস্তবতা হচ্ছে, হাজার হাজার নারীর মধ্যে ফারজানা হচ্ছে এক ব্যাতিক্রম যাদের কিনা যৌতুকের মত অভিশাপের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। কখন সমাজ এর বিরুদ্ধে জেগে উঠবে?