মিয়ানমার: সু চীর মুক্তির এক বছর পর

গত ১৩ নভেম্বর,২০২০ তারিখে অং সান সুচীর মুক্তিতে মিয়ানমারের বার্মিজ জনগণ ও সারা বিশ্ব আনন্দিত হয়েছিল। তাঁর মুক্তির প্রায় এক বছর হতে চলল। মেদারউই সু চীর মুক্তির পরপরই তাঁর ব্লগে লিখেন:

আমি ভাবতাম যে আমার পরীক্ষার পরেই আমি আবার ব্লগ লিখতে শুরু করব, কিন্তু আজকে একটি আনন্দদায়ক ঘটনার কারনে আমি ব্লগ লিখছি। গতকাল থেকে একটা ভুয়া সংবাদ শোনার কারনে আমার মন অবসন্ন। এ ধরণের খবর প্রায়শই পেয়ে থাকি যে খবরগুলো মাঝে মাঝেই মিথ্যা হয়। আশা করি খবরটি যেন সত্যি হয়, যদিও মনে কোন জোর পাচ্ছিনা। বের হওয়ার আগে যখন সকালের নাস্তা খাচ্ছিলাম তখন চাচা বললেন গতকাল আমি যে খবরটি শুনেছিলাম তা এখনও নিশ্চিত নয়। শুনে মনটা আরও খারাপ হয়ে গেল। দুপুর ১ টায় বাড়ি ফেরার পর আমি ক্ষুধার্ত থাকার কারনে দুপুরের খাবার তৈরি করছিলাম এবং তখনই চাচা রান্নাঘরে ঢুকে আনন্দিত হয়ে ঘোষণা করলেন, “তিনি মুক্তি পেয়েছেন!” আমরা আমাদের দুপুরের খাবারকে টেবিলে ফেলে রেখে দীর্ঘ সময়ের জন্য টেলিভিশনের সামনে বসলাম। আমরা ভুলেই গিয়েছিলাম যে আমরা ক্ষুধার্ত। আসলে এ খবরটির জন্য আমরা দীর্ঘ বছর ধরে প্রতীক্ষায় ছিলাম। আন্টি সু -এর বাড়ির সামনে উল্লসিত জনতাকে দেখে আমি আনন্দিত হই, রোমাঞ্চিত হই, আমার দুচোখ বেয়ে অশ্রু ঝরে পড়ে। টিভির পর্দায় আন্টি সু-এর ঝাপসা মুখ থেকে আমার দৃষ্টি ফেরেনা। একই সাথে আমি আনন্দিত ও দুঃখিত হয়ে পড়ি। এক অবর্ণনীয় অনুভূতি আমার মাঝে খেলা করে।

 

হিথু তায়জার নামে একজন বার্মিজ ব্লগার সু চীর মুক্তির পর জনতার উদ্দ্যেশ্যে সু চীর ভাষণ শোনার জন্য এন এল ডির প্রধান কার্যালয়ে যান। তিনি লিখেন:

সকাল ১০টা ৩০ মিনিটে অনেক লোকই সেখানে উপস্থিত ছিলেন, তাঁদের অনেকের হাতেই “আমরা সু চীকে ভালবাসি” লেখা পোস্টার ছিল। আমি লক্ষ্য করলাম সেখানে ট্রাফিক পুলিশ ছাড়া আর কোন  সামরিক পোশাকধারী ছিলনা। প্রধান কার্যালয়ের সামনের পানের দোকান, চায়ের দোকানগুলোতে অনেক লোক ছিল। দাদা, দাদীরা তাঁদের নাতি-নাতনির হাত ধরে সেখানে এসেছিলেন। আবালবৃদ্ধ বণিতার এক সমাবেশ সেখানে ঘটেছিল

যদিও “জায়গাটা এতই জনাকীর্ণ ছিল যে পায়ের আঙ্গুলের উপর দাঁড়িয়ে ছবিগুলো তুলতে হয়েছে” তারপরেও তিনি এ ঘটনার অনেকগুলো ছবি  তুলেন ক্যাও থু নামের একজন অভিনেতা যিনি মৃতদের বিনামূল্যে সৎকারের সমিতি স্থাপন করে মানুষের হৃদয় জয় করেছেন, তিনি তাঁর আঁকা সুচীর ছবি সুচীকে উপহার দেন। সু চীর মুক্তিতে তাঁর অনুভূতি কি জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন:

আমরা আমাদের জীবনে এখন উষ্ণ আলো পেলাম। আমি চাইনা আমরা লক্ষ্যভ্রষ্ট হই। আমরা চাইনা ভয়ের কারনে আমরা আমাদের জীবনের কাজ থেকে পিছপা হই। এখন ‘মা” সুচী আমাদেরকে আমাদের পথ দেখাতে পারেন। তাঁর মুক্তিতে আমাদের কেবল খুশিতেই সীমাবদ্ধ থাকলেই চলবেনা। আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হল তাঁর নির্দেশনা মেনে চলা।

অনেক স্থানীয় সংবাদপত্রে তাঁর মুক্তির বিষয়টিকে কঠোর সেন্সরশীপ-এর কারনে প্রধান সংবাদ শিরোনামে পরিণত করতে পারেনি। যদিও একটি স্থানীয় খেলাধুলার পত্রিকার শিরোনামে  লেখা হয়েছিল, ” সুন্দারল্যান্ড ( সান্দারল্যান্ড) ফ্রিজ চেলসি”, ইউনাইটেড স্টান্ড বি ভিলা” অ্যান্ড ” আরেসেনাল আডভান্সড টু গ্র্যাব দেয়ার হোপ“-এ শিরোনামগুলোর বোল্ড করা অক্ষরগুলোকে একত্র করলে মানে দাঁড়ায় “সু  ফ্রি। ইউনাইট অ্যান্ড আডভান্সড টু গ্র্যাব দেয়ার হোপ”। খেলাধুলার এ পত্রিকাটিকেও কেবলমাত্র শিরোনামের কারনে  সপ্তাহের জন্য নিষ্ক্রিয় করে রাখা হয়েছিল। উল্লেখ্য যে সু চির মুক্তির খবর প্রথম পাতায় ছাপানোর কারণে আরও ৯ টি স্থানীয় সংবাদপত্রের প্রকাশনাকে এক সপ্তাহের জন্য স্থগিত রাখা হয়।

২০১১ সালে নতুন সরকার আসার পর অং সান সু চির সংবাদ প্রকাশের বিষয়ে সংবাদপত্রের সেন্সরশীপ শিথিল করা হয়। পাই থু খিত সংবাদপত্রে সু চি “আমার ছুটির দিনগুলো” শিরোনামে একটি নিবন্ধ লিখেন।

২০১১ সালের জুলাই মাসে তিনি (সু চি) তাঁর ছেলেকে সাথে নিয়ে বাগান সফর শুরু করেন। গৃহ বন্দিত্ব থেকে মুক্তির পর ইয়াঙ্গুনের বাইরে এটা ছিল সু চির প্রথম সফর। শত শত স্থানীয় জনতাকে তিনি শুভেচ্ছা জানান, এরমধ্যে অল্প কিছু লোক তাঁর সাথে দেখা করতে সক্ষম হন। স্থানীয় একজন বলেনঃ

” আমি আমার দেশের মেয়েকে দেখে খুবই আনন্দিত”, প্যাগোডার সামনে ফুল বিক্রি করেন এমন একজন ৭০- বছর বয়সী ব্যক্তি বলেন ” একমাত্র সু চি ই পারেন দেশটাকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে”।

কোচিন রাজ্যে মাইস্টোন বাঁধ বাস্তবায়নের বিষয়ের তিনি বিরোধী ছিলেন। বছরের পর বছর কারাবন্দী থাকার পর তিনি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হন। অনেকগুলো কর্মসূচীতে তিনি যোগ দেন যেমন “ স্কেচ অব রিভার আর্ট একজিবিশন“, ” ভারতীয় দূতাবাসে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৫০তম জন্মজয়ন্তী“, একটি ফুটবল খেলার অনুষ্ঠান, সম্প্রতি চালু হওয়া বেদার পাঠাগার। তিনি শিল্প মুক্তির চলচ্চিত্র উৎসবের পৃষ্ঠপোষকতা করেন। এ উৎসবের পুরস্কারের অর্থায়ন তিনি করেন।

২০১১ সালের আগস্ট মাসে প্রথমবারের মত তিনি মিয়ানমারের রাষ্ট্রপতি উ থিন সিন-এর সাথে দেখা করেন, এবং তিনি (সু চি) বলেন রাষ্ট্রপতির সাথে তাঁর সাক্ষাত সন্তোষজনক

২০১১ সালের আগস্টে রাষ্ট্রপতি উ থিন সিন-এর সঙ্গে সু চি, ছবি- মিয়ানমার টাইমস এর সৌজন্যে

তিনি অনেক বিদেশী গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গের সাথে সাক্ষ্যাত করেন এর মধ্যে মার্কিন সিনেটর জন ম্যাককেইন অন্যতম। সংসদে নির্বাচন আইন সংশোধনের পর ইতোমধ্যে সু চি তাঁর রাজনৈতিক দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমক্রাসী (এন  এলডি) কে  পূনঃ নিবন্ধনের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তিনি বলেনঃ

আমাদের দল  এন এল ডিএর পূনঃ নিবন্ধনের বিষয়টি নির্ভর করছে আইনের উপর। আইনটি কার্যকর হওয়ার জন্য আমরা অপেক্ষা করছি। আইনটি কার্যকর হওয়ার পর দলের আইন অনুযায়ী সভা করে আমরা আমাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবো। আমরা খুবই নিয়মনিষ্ঠ। আইন অনুযায়ী আমরা সবকিছু করবো। এ কারনেই আমি সিদ্ধান্ত নিতে পারিনি কেননা আমি এখনও আইনটি দেখিনি”।

১৩ নভেম্বর ২০১১ তারিখে তিনি এন  এল ডি-এর প্রধান কার্যালয়ে তাঁর মুক্তির এক বছর উদযাপন উপলক্ষ্যে এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করবেন।

আলোচনা শুরু করুন

লেখকেরা, অনুগ্রহ করে লগ ইন »

নীতিমালা

  • অনুগ্রহ করে অপরের মন্তব্যকে শ্রদ্ধা করুন. যেসব মন্তব্যে গালাগালি, ঘৃণা, অবিবেচনা প্রসূত ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকবে সেগুলো প্রকাশের অনুমতি দেয়া হবে না .