দক্ষিণ কোরিয়া: রাজকীয় পুস্তকের প্রত্যাবর্তন বিষয়ে বিতর্ক

ইউইগেউই (কোরিয় ভাষায় 의궤) কোরীয় রাজকীয় কিছু পুস্তকের এক সংগ্রহ যা ১৮৬৬ সালে কোরিয়ার কানাঘাওয়া দ্বীপে ফরাসীদের হামলার সময় তারা এই সব পুস্তক লুট করে নিয়ে যায়। অবশেষে দীর্ঘ ১৪৫ বছর পর ২০১১ সালে এগুলো আবার স্বদেশে ফিরে আসে।

১১ জুনে দক্ষিণ কোরীয় সরকার এক বিশাল ঐতিহ্যবাহী অনুষ্ঠানের মাধ্যমে এই সব রাজকীয় পুস্তকের প্রত্যাবর্তন উদযাপন করে। সেই সাথে তারা সিদ্ধান্ত নেয় যে ১৯ জুলাই থেকে ১১ সেপ্টম্বর পর্যন্ত জাতীয় ইতিহাস সংগ্রহশালায় (ন্যাশনাল মিউজিয়াম অফ হিষ্ট্রি) প্রদর্শনের সিদ্ধান্ত নেয়। তবে এই বিষয়ে এক বিতর্ক থেকে যাচ্ছে যখন কোরিয়ার এই রাজকীয় পুস্তকের প্রত্যাবর্তনের বিষয়টি কোরীয়ার সমস্যা জর্জরিত আধুনিক ইতিহাসের সাথে গভীরভাবে যুক্ত।

রাজকীয় পুস্তকের এই প্রত্যাবর্তনের বিষয়টি অর্জন হয়েছে ফরাসী সরকারের সাথে এক লম্বা সময়ের দরকষাকষির পর, অনেকে এই প্রত্যাবর্তনকে উষ্ণতার সাথে স্বাগত জানিয়েছে। তবে নানাবিধ বিতর্ক তখন শুরু হয়, যখন জানা যায় যে রাজকীয় এই সম্পদ চিরস্থায়ী ভাবে প্রত্যাবর্তনের পরিবর্তে সাময়িক কিছু শর্তে “ভাড়া” হিসেবে ফেরত আনা হয়েছে। ফরাসী সরকারের সাথে কোরিয়ার সরকারের এই চুক্তি নবায়ন করতে হবে, শিল্পকর্মকে দেশে রাখতে চাইলে প্রতি পাঁচ বছর পর পর চুক্তি নবায়ন করতে হবে।

তবে বেশীর ভাগ কোরীয় নাগরিক এই সংবাদে উত্তেজিত। ১১ জুনে এই রাজকীয় পুস্তকের আগমন উপলক্ষ্যে যে স্বাগত অনুষ্ঠান উদযাপন করা হয়, ব্লগার জোইয়ো সেখানে উপস্থিত ছিল। সে বর্ণনা করছে [ কোরীয় ভাষায়] কি ভাবে লোকজন জাতীয় সম্পদের প্রত্যাবর্তনে উল্লাসে ফেটে পড়ে:

외규장각 의궤는 비록 ‘대여'라는 이름으로 계속 연장을 해야한다고는 하지만 중요한 건 ‘컴백홈'을 했다는 것!

যদিও শর্ত সাপেক্ষে রাজকীয় পুস্তকের প্রত্যাবর্তন ঘটেছে, যা মুলত “ভাড়া” নামক শর্ত, যার ফলে এই সব বইকে রাখতে চাইলে সবসময় চুক্তি নবায়ন করতে হবে, কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ণ বিষয় হচ্ছে আমরা আবার এখানে তা ফিরে পেয়েছি।

কোরিয়ার ঐতিহ্যকে বোঝার ক্ষেত্রে, সৌন্দর্য্য এবং ঐতিহাসিক মূল্যের দিক থেকে ইউইজিউই-এক অতি উচ্চ মূল্যের সম্পদ। ব্লগার কুকইডসিগার এই দৃষ্টিভঙ্গির উপর আলোকপাত করেছে [কোরীয় ভাষায়]:

예로부터 내려온 것은 작은 못 하나라도 민족의 혈이 흐르는 보물이 아닌가 합니다.

ঐতিহ্য সুত্রে প্রাপ্ত জিনিষ অনেক মূল্যবান। জাতীর চেতনা এসবের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হয়। এমনকি সবচেয়ে যে ছোট্ট কাঁটাও সেটিও এক চেতনা ধারণ করে।

জাতীয় গর্ব এবং অপমান এক সাথে যুক্ত হওয়া

এই সম্পদ ভাড়া নেবার সিদ্ধান্তটি ফরাসী অভ্যন্তরীণ আইনের উপর ভিত্তি করে গ্রহণ করে হয়েছে এবং কূটনৈতিক বিশ্বে বিষয়টিকে এ ভাবে ভাবা হবে যে বাস্তবিক পক্ষে ফরাসী সরকার এই ফিরিয়ে দেবার বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। কিন্তু এই ব্যাখ্যা কোরীয়দের সন্তুষ্ট করতে পারেনি। ব্লগার বিনবিনি যুক্তি প্রদান করেছে যে এই বিনিময় অনৈতিক এবং অদুরদৃষ্টি সম্পন্ন [কোরীয় ভাষায়]:

정부와 외교 통상부가 하는 말을 보시라. 갱신 형식으로 사실상 영구 대여가 된다. 일단 돌아온 문화재를 빼앗아 가겠느냐. […]원래 우리나라에 있던 문화재를 강제로 약탈해 갔습니다.

প্রশাসনের প্রধান এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের প্রধান কি বলছে আসুন আমরা তা খেয়াল করি: এটা আসলে “স্থায়ী ভাবে ভাড়া নেওয়া”, বিশেষ করে যতক্ষণ আমরা এই চুক্তি নবায়ন করে যাব ততক্ষণ এটা আমাদের এবং এটা নিয়ে তারা কি করবে? একবার যদি এই সম্পদ কোরিয়ায় এসে হাজির হয় তাহলে সম্ভবত তা আর আমাদের কাছ থেকে নিয়ে নিতে পারবে না। তারা ভুলে গেছে যে ফরাসীরা হামলার সময় এগুলো আমাদের কাছ থেকে লুট করে নিয়ে গিয়েছিল।

The National Museum of History in Seoul

দক্ষিণ কোরিয়ার সিউলে অবস্থিত জাতীয় ইতিহাস সংগ্রহশালা। ছবি ফ্লিকার ব্যবহারকারী রেডিওহাটের-এর (সিসি বাই-এনসি-এনডি ২.০)।

এই ভিন্নতা এক জটিল ধাঁধার সৃষ্টি করে, যা এক জাতীয় গর্ব এবং অপমানের সাথে যুক্ত হয়ে আছে। যেমন উদাহরণ হিসেবে বলা যায় ব্লগার এ স্মল ওয়ার্ল্ড ইন দি ওয়ার্ল্ড ফরাসী সরকারের মনোভাব এবং তার যে স্বল্প সময়ের জন্য ফেরত দিচ্ছে এই সিদ্ধান্তে তার অসন্তোষ ব্যক্ত করেছে [কোরীয় ভাষায়] :

솔직히 남의 나라에서 약탈해 간 문화재를 이정도까지 완벽하게 보관해 줬다는 점에서는 프랑스에 감사했습니다.[…]애초 외규장각 의궤는 우리나라 겁니다. 긴 세월 남의 나라 도서관에 있다가 원래 있어야 할 곳으로 돌아오는 것 뿐입니다. 우리나라 입장에서 보면 나쁜 놈들이 뺐어간 내 물건 되찾아 오는 겁니다.

স্পষ্টভাবে বললে, ফরাসী সরকার যে এত বছর ধরে আমাদের জাতীয় সম্পদ সঠিক ভাবে সংরক্ষণ করেছে, তার জন্য আমি তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ। [তবে] ইউইজিউই প্রথমত আমাদের জাতীয় সম্পদ। এটা আমাদের কাছ থেকে চুরি করে নিয়ে যাওয়া হয়ছে এবং একটা বিদেশী রাষ্ট্রের লাইব্রেরীতে অনেক বছর ধরে রাখা ছিল। [এভাবে] একজন কোরীয় নাগরিকের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বলতে পারি, ফ্রান্সের কাছ থেকে এটা ফেরত পাওয়ার বিষয়টি হচ্ছে আমাদের নৈতিক অধিকার।

ব্লগার এর সাথে আরো যোগ করেছে:

더구나 외규장각 의궤에 관련해선 프랑스는 우리국가를 상대로 대놓고 거짓말을 한 전력이 있습니다. 고속철도 도입 당시 프랑스 일본 독일 등의 고속철에 대한 논의가 있었을 때, 우리나라가 프랑스 TGV를 선택한 결정적인 이유가 프랑스 대통령이 약속한 외규장각 도서 반환에 대한 약속 때문이라고 해도 과언이 아닙니다. 당시 미래를 생각하면 일본 고속철도가 더 나은 선택이라는 말이 있었지만, 저 약속 때문에 프랑스 TGV를 선택한 것입니다.

তারচেয়ে বড় কথা অতীতে রাজকীয় এই সব পুস্তক ফেরত দেবার বিষয়ে ফরাসী সরকার আমাদের কাছে এক নির্জলা মিথ্যা বলেছে। যখন দক্ষিণ কোরিয়ায় উচ্চ গতি সম্পন্ন রেল বসানোর জন্য আমরা ফ্রান্স, জাপান এবং জার্মানীর মধ্যে কাকে বেছে নিবে তার ক্ষেত্রে দ্বিধান্বিত ছিলাম, সে সময় ফরাসী রাষ্ট্রপতি এই সব রাজকীয় পুস্তক ফেরত দেবার বিষয়ে এক শক্তিশালী প্রতিশ্রুতি প্রদান করেন। এই প্রতিশ্রুতির কারণে আমরা অন্য দেশের কোম্পানীসমুহকে বাদ দিয়ে ফরাসী টিজেভে-কে এই কাজে নিয়োগ দেই। সে সময় কিছু নাগরিক পরামর্শ প্রদান করেছিল যে ভবিষ্যৎ-এর জন্য জাপানের রেল প্রযুক্তি গ্রহণ করা হবে উত্তম । কিন্তু তারপরেও আমরা ফ্রান্সের টিজেভেকে গ্রহণ করি, কারণ আমরা তীব্রভাবে আমাদের রাজকীয় পুস্তক সমূহ ফেরত পেতে চাইছিলাম ।

যদিও ব্লগার বিষয়টিকে বিস্তারিত ভাবে তুলে ধরেনি, কিন্তু তার এই লেখা থেকে এই বিষয়টি অনুধাবন করা কঠিন নয় যে তার লেখার অক্ষর উপনিবেশিক সময়ের কোরীয় মানসিকতার দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরছে। তার এই পোস্টের শিরোনাম “রাজকীয় পুস্তকের প্রত্যাবর্তনঃ যখন আমরা জাপানের দখলদারিত্বের বিষয়ে অপমানিত বোধ করছি, তখন কেন আমরা ফরাসী হামলার বিরুদ্ধে এত বিনয়ের সাথে আমাদের প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন করছি?” [কোরীয় ভাষায়] এবং খেয়াল করুন যে ব্লগার এখানে তার প্রথম বাক্যে “নির্জলা মিথ্যা” নামক শব্দটি বেছে নিয়েছে। পরস্পরের সাথে আলোচনার মত একটি বিষয়ে সে এত আবেগময় একটি শব্দ বেছে নিয়েছে, যেখানে লাভ এবং সুবিধা একটা বিষয় এবং ঠাণ্ডা মাথায় হিসেব করার বিষয়টি হচ্ছে একমাত্র ভাষা যা দুই পক্ষ ব্যবহার করবে।

মোটের উপর, কোরীয় জনতাকে স্বল্প সময়ের জন্য ফেরত পাবার বিষয়টি গ্রহণ করার জন্য চাপ দেওয়া অদূরদর্শী বিষয়। নিজেদের বেদনাদায়ক ইতিহাসের প্রতি জনতার মনোভাব এবং অনুভূতি এবং কি ভাবে তাদের দৃষ্টভঙ্গি কোরিয়ার বর্তমান সমাজের উপর প্রভাব বিস্তার করে এই বিষয়টি এতে ধরা পড়ে না।

আলোচনা শুরু করুন

লেখকেরা, অনুগ্রহ করে লগ ইন »

নীতিমালা

  • অনুগ্রহ করে অপরের মন্তব্যকে শ্রদ্ধা করুন. যেসব মন্তব্যে গালাগালি, ঘৃণা, অবিবেচনা প্রসূত ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকবে সেগুলো প্রকাশের অনুমতি দেয়া হবে না .