মরক্কো: পরিবর্তনের হাওয়া

গত একমাস ধরে মরক্কোর জনগণ সংবিধান সংশোধন ও গণতান্ত্রিক সংসদীয় শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তনের দাবিতে রাজপথে আন্দোলন করে আসছে। ১০ মার্চ রাষ্ট্রের বাদশাহ, বাদশাহ ষষ্ঠ মোহাম্মদ তাঁর ভাষণে সংবিধান সংশোধন, পুনর্বিন্যাস, ক্ষমতা স্বতন্ত্রী-করণ এবং নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী ও সংসদের ভুমিকা শক্তিশালীকরনের প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেন।

প্রখ্যাত মরক্কোর সাংবাদিক আহমেদ বেঞ্ছেমসি পিস ইন লো মঁদ পত্রিকায় এ সংক্রান্ত একটি লেখা লিখেন, যা পরবর্তীতে স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে ইংরেজীতে প্রকাশিত হয়। তিনি বলেন:

মরোক্কান তরুণেরা গণতন্ত্রের দাবিতে বিক্ষোভ অব্যাহত রেখেছে, রাবাত,মরক্কো। ছবি- জাকারিয়াস গার্সিয়া,স্বত্ব-ডেমোটিক্স

মরোক্কান তরুণেরা গণতন্ত্রের দাবিতে বিক্ষোভ অব্যাহত রেখেছে, রাবাত, মরক্কো। ছবি- জাকারিয়াস গার্সিয়া, স্বত্ব-ডেমোটিক্স

খুব কমই বিশ্বাসযোগ্য কৌশলী বক্তৃতার পরেও ষষ্ঠ মোহাম্মদ নিজেকে বিপজ্জনক অবস্থানে রেখেছেন। সংবিধানের চুড়ান্ত খসড়া দেখতে যেমনই হোক না কেন তার বৈধতার জন্য গণভোট গ্রহন করতে হবে। যদি তাই হয় তবে বাদশাহ এক পদ্ধতি থেকে অন্য পদ্ধতি উন্মুক্ত করতে বাধ্য হবেন। বেসরকারি টেলিভিশনে আন্দোলনকারীদের “না” অস্পৃশ্য “পূজনীয়” উদাহরণের বিরুদ্ধে বড় ধরণের চ্যালেঞ্জ। বিশ্বাসীদের সেনাপতির প্রদত্ত আদেশ কি করে কিছু মরোক্কান অগ্রাহ্য করতে পারে আর তা কি ভাবেই বা রাজকীয় প্রাসাদ মেনে নিতে পারে? চাপ দিয়ে রাজতন্ত্র আসলে চুড়ান্ত বৈপরীত্যের দিকে যাচ্ছে। ঐশ্বরিক না গণতান্ত্রিক? সময় এসেছে সিদ্ধান্ত নেওয়ার…

…মার্চের ২০ তারিখ থেকে বড় ধরণের প্রতিবাদ শুরু হচ্ছে। মনে হচ্ছে সরকারের কাছে আর কোন ভাল বিকল্প নেই। মুখোশ ছুড়ে ফেলে বিক্ষোভকারীদের প্রতি বর্বরোচিত দমন তাঁদের ক্রোধকে আরও বৃদ্ধি করবে। এখন পর্যন্ত রাস্তায় যে স্লোগান দেওয়া হচ্ছে তাতে বাদশাহকে অক্ষত রাখা হয়েছে। এ অবস্থা পরিবর্তিত হতে পারে। মিসরের মত কোন কিছু ঘটতে পারে যা-বাস্তবিক ই কর্তৃপক্ষের জন্য দু:স্বপ্ন। অপরদিকে বিক্ষোভ স্বাধীনভাবে করতে দিলে জনগণের ক্ষমতায়ন ঘটবে এবং রাস্তায় জন অংশগ্রহন বৃদ্ধি পাবে যা রাজতন্ত্রকে চাপে রাখবে।

আজ হোক বা কাল হোক ষষ্ঠ মোহাম্মদ কে নতুন করে পরিস্থিতি বিবেচনা করতে হবে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে কখন ও কোন পরিপ্রেক্ষিতে? তা এ অস্থির অবস্থায় ধারণা করা কঠিন। একটা বিষয় নিশ্চিত: গণতন্ত্রের প্যান্ডোরার বাক্স খোলা হয়েছে এবং এটা আর বন্ধ করা যাবেনা।

প্রকৃতপক্ষে ২০ মার্চ তারিখ কে মরক্কো জুড়ে আরেকটি প্রতিবাদ দিবস হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। মরক্কোর ছোট-বড় শহরজুড়ে এ শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ টুইটার, ফেসবুক, ইউটিউবে ভালভাবে উপস্থাপিত হয়েছে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী মার্টাস(মহিলা) তাঁর বন্ধু মরোক্কানদের উদ্দেশে লিখেন :

আমি মরক্কোর শান্তিপূর্ণ বিপ্লবে বিশ্বাস করি যা অনবদ্য ইতিহাসের অংশ হবে… কারন গত কয়েক বছর ধরেই বিষয়টি গতিশীলতা পাচ্ছিল যার পরিনতি আজ দৃশ্যমান। নিঃসন্দেহে নতুন বাদশাহর সংস্কার সাম্প্রতিক মাসগুলোতে এ ঘটনার জন্ম দিয়েছে, সন্দেহাতীতভাবে সামপ্রতিক মাসগুলোতে পরিস্থিতির পরিবর্তন এ অঞ্চলের পরিবর্তনের হাওয়াকে আরো গতিশীল করেছে।

লায়লা লালামি টুইটারে লিখেন, সুনিশ্চিতভাবেই পরিবর্তন দেখতে পাচ্ছি:

আপনার জানেন #মরক্কোর অবস্থা পরিবর্তিত হচ্ছে। সরকারি সংবাদ সংস্থার সাংবাদিকরা ধর্মঘট ডেকেছে এবং এক সময় এ সাংবাদিকরা জনগণকে মিথ্যা অপবাদ দিত আজ সেই জনগণই তাঁদেরকে সমর্থন দিচ্ছে।

মাহমুদ সিদ্দিক বিষয়টিকে দেখেন জাতীয় হতাশা হিসেবে। তিনি তাঁর ব্লগ সত্বার প্রবাহ-তে লিখেন:

যারা শুধুমাত্র প্রধান খাদ্য ও নির্দিষ্ট রাজনৈতিক সংস্কারের বিষয়ে দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখেন তাঁরা আসলে অদূরদর্শী। বাস্তবিকপক্ষে, ২০ ফেব্রুয়ারির চেতনা শুধুমাত্র বৈধ সামাজিক কল্যাণের প্রত্যাশা নয় বরং মনস্তাত্বিক অবমুক্তির আকাঙ্খাও বটে। সহজ ভাবে বলতে গেলে মরোক্কানদের আনন্দ করা প্রয়োজন।
আমাদের এখন যা দরকার তা হলো ভিতরের আবেগকে বের করে দিয়ে একজন খাটি মরোক্কান হিসেবে জাতীয় ভাবে আনন্দ-উল্লাস করা। আমরা সবাই একতার স্বাদ উপভোগ করতে চাই এবং এক জাতি হিসেবে ব্যর্থতা, কষ্টকে মুছে ফেলে খাটি আনন্দ উৎসব করতে চাই। সংক্ষেপে বলতে গেলে আমাদের সঙ্কট কেবলমাত্র অর্থনৈতিক এবং সামাজিক নয়, এটা আনন্দের সঙ্কটও বটে।

বর্তমান শাসনামলে কয়েক দশক ধরে জাতীয়ভাবে আনন্দ প্রকাশ করা বিলাসে পরিণত হয়েছে। কয়েক বছর ধরে আনন্দ আমাদের হৃদয় থেকে বিতাড়িত, আমাদের গলিগুলো থেকে উৎসব পরিত্যক্ত এবং উৎফুল্লতা গুজবের বিষয়ে পরিণত। আমরা নির্ভরশীলতা, চাপ এবং অতৃপ্তির সহজ শিকার। দীর্ঘশ্বাস মরোক্কানদের প্রাত্যহিক জীবনের ভাষা যেখানে প্রত্যেক মরোক্কাবাসীর কাছে ভ্রুকুটি এবং রুষ্ট চেহারা গ্রহণযোগ্য।

দি মুরিশ ওয়ান্ডারারমৌলিক ইশতেহার” প্রকাশ করেছে যেখানে রাজনৈতিক প্রতীকবাদের চাইতে সুনির্দিষ্ট নীতি কার্যক্রম স্থান পেয়েছে যাকে তিনি মরক্কোর রাজনৈতিক দলগুলোর দূর্বলতা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। এ ইশতেহারে তিনি কিছু পরামর্শ দেন [সংক্ষেপিত]:

১.ক্ষমতার রাজনৈতিক বিভাজন: আমরা এভাবে চলতে পারিনা। এটা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই যে, মূল গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার সাথে রাজতন্ত্রের বৈধতা পরস্পর বিরোধী।আধিপত্যবাদী রাজনৈতিক ক্ষমতা ভিন্ন মতাবলম্বীদের কণ্ঠরোধ করা হতো দমনের মাধ্যমে কিন্তু বিরোধী দলের ক্ষমতায় আরোহণের সম্ভাব্য কর্মকৌশলকে ও অস্বীকার করা হত। মোহাম্মদ সাসি বিষয়টিকে মার্জিতভাবে প্রকাশ করেছেন: উত্তরাধিকারের রাজতন্ত্র ও প্রকৃত গণতন্ত্রের মধ্যে একমাত্র উপযুক্ত মেলবন্ধন ঘটতে পারে সংসদীয় রাজতন্ত্রের মাধ্যমে।

২. সামাজিক প্রকল্প: উন্মুক্ত সমাজ; কঠোর ইসলামী সমাজে অমুসলিমদের বসবাস দুঃস্বপ্নের মত। উন্মুক্ত সমাজ প্রকৃত বিশ্বাসীদের জন্য কোন বিরক্তির উদ্রেক করেনা বললেই চলে। রাজনৈতিক বহুমুখিতা আবশ্যিক ভাবেই সমাজের বহুমুখিতাকে দাবি করে। ইসলামী আন্তর্জাতিকতাবাদের মত উম্মাহ মীথটিও বহু আগেই পরিত্যক্ত। (প্যান-আরবীয় নাসিরীয়বাদ ও ইসলামী আন্তর্জাতিকতাবাদ)। মরক্কোর জাতিগুলোর (বিশ্বাস করুন এ বহুবচনটি টাইপের কোন ভুল নয়) রয়েছে বলিষ্ঠ ইসলামিক পরিচয় কিন্তু এগুলো ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা বা সংস্কারে পরিণত হয়েছে (ইসলামী বিশ্বাস এবং আরব বিজয়ীদের নির্মূল প্রচেষ্টায় ব্যর্থ হওয়া জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠান মিলেমিশে এক হয়ে গেছে)।

৩. অর্থনৈতিক পুন:সংস্কার: মরক্কোর অর্থনীতিবিদগণ (যারা আসরেই অর্থনীতি বোঝেন) তাঁদের সাধ্য অনুয়ায়ী জনগনকে ভ্রান্ত ধারণা থেকে মুক্ত করতে সচেষ্ট রয়েছেন: মরক্কো সাহায্য নির্ভর অর্থনীতিতে ঢুকে পড়েছে। এর কাঠামোর কোন পরিবর্তন কিংবা নবায়ন করা হয়নি। উচু পর্যায় থেকে নিচু পর্যন্ত সবারই একটা প্রবনতা হল ‘নিরাপদ বিনিয়োগ’: যদিও আমরা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ভালো অবস্থানে রয়েছি তার পরেও সরকারি চাকুরিতে কমর্সংস্থানের সুযোগ না থাকা, বেসরকারি প্রতিষ্ঠনের একচেটিয়াত্ব, অনুৎপাদনশীল খাতে সম্পদশালীদের বিনিয়োগ মরক্কোর অর্থনীতির জন্য সহায়ক নয়। এছাড়া সম্প্রসারণের সুবিধা স্বল্প সংখ্যকের মধ্যেই সীমাবদ্ধ (মরক্কোর ১০% বিত্তবান ৪০%(disposable income) কর কর্তনের পরের প্রাপ্ত বেতনকে হস্তগত করে।)

আলোচনা শুরু করুন

লেখকেরা, অনুগ্রহ করে লগ ইন »

নীতিমালা

  • অনুগ্রহ করে অপরের মন্তব্যকে শ্রদ্ধা করুন. যেসব মন্তব্যে গালাগালি, ঘৃণা, অবিবেচনা প্রসূত ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকবে সেগুলো প্রকাশের অনুমতি দেয়া হবে না .