- Global Voices বাংলা ভার্সন - https://bn.globalvoices.org -

পাকিস্তান: ব্লাসফেমি আইনের লজ্জাজনক ব্যবহার

বিষয়বস্তু: দক্ষিণ এশিয়া, পাকিস্তান, আইন, ধর্ম, নাগরিক মাধ্যম, মানবাধিকার

পাকিস্তানের ব্লাসফেমি আইনের [1] (স্রষ্টা বা দেবতা বা প্রেরিত পুরুষদের বিরুদ্ধে নিন্দা সূচক বাক্য ব্যবহারকারী বা অপমানকারী ব্যক্তির বিচার করার জন্য যে আইন) ব্যবহার অনেক লম্বা সময় ধরে বিতর্ক তৈরি করে আসছে এবং মানবাধিকার কর্মীরা এই আইনের সমালোচনা করেছে এবং এই ব্যাপারে প্রশ্ন উত্থাপন করছে। যখন থেকে এই আইন চালু হয়েছে, তখন থেকেই এটি সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে আক্রমণ এবং তাদের ভেতর আতঙ্ক ছড়িয়ে দেবার জন্য প্রয়োগ করা হয়েছে।

এর এক সাম্প্রতিকতম উদাহরণ হচ্ছে আসিয়া বিবি [2]। এই ঘটনায় এক খ্রীষ্টান মহিলার বিরুদ্ধে ব্লাসফেমির অভিযোগ আনা হয় এবং ঘটনাক্রমে তাকে মৃত্যদণ্ড প্রদান করা হয়। পাকিস্তানের অনলাইন সম্প্রদায় এই ঘটনার জোরেশোরে নিন্দা করতে থাকে। এমনকি এই রকম একটি ঘটনা যেন যথেষ্ট ছিল না, এরপর হায়দ্রাবাদের এক ডাক্তারকে ব্লাসফেমির অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়, পরে জানা যায় যে এটি এক মিথ্যা অভিযোগ।

চুপ-চেঞ্জিং আপ পাকিস্তানের কালসুম জানাচ্ছে [3]:

এবার পুলিশ, নওশাদ ভালিয়ানি নামের হায়দ্রাবাদের এক ডাক্তারকে গ্রেফতার করে। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, সে রাসুল হজরত মুহাম্মদকে (সঃ) অপমান করেছে। ভালিয়ানি ইসমাইলিয়া সম্প্রদায়ের এক মুসলমান নাগরিক। একজন মেডিকেল রিপ্রেজেনটেটিভের অভিযোগের ভিত্তিতে তাকে গ্রেফতার করা হয়। এই রিপ্রেজেনটেটিভ বলেছে, সে যখন ডাক্তারের ক্লিনিকে গিয়েছিল, তখন ডাক্তার তার বিজনেস কার্ডটি এক ডাস্টবিনে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল। এই কার্ডের মধ্যে তার পুরো নাম মুহাম্মদ ফাইজান লেখা ছিল।

অল থিংস পাকিস্তানে, আদিল আনজুম এই অদ্ভুত অভিযোগ সম্বন্ধে তার পোস্টে [4] লিখেছে:

রাসুলের নাম ব্যবহার এখানে ব্যর্থ হয়েছে। নিজের ঘৃণা উগরে দেওয়ার জন্য নবী হজরত মুহাম্মদ (সঃ) এর বাণী এবং তার নামের ব্যবহার করা মানে তাকে অপমান করা। যদি কেউ রাসুলের নামকে শ্রদ্ধার সাথে ব্যবহার করতে চায় বা “নামোস-ই রাসুল”-এর ব্যবহার করে, সে অবশ্যই অপমানিত এবং ক্রোধান্বিত হবে এই কারণে যে, কি ভাবে এই শ্রদ্ধাশীল নাম (নামোস) কারো বিরুদ্ধে অদ্ভুত এক অভিযোগের কারণ এবং ব্লাসফেমির নামে ঘৃণা সৃষ্টির বাহক হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।

অনেক বিখ্যাত ব্লগার এখন সক্রিয়ভাবে ব্লাসফেমি আইন সংশোধনের উদ্যেগের জন্য কাজ করে যাচ্ছে, মনে হচ্ছে পাকিস্তানের ক্ষমতাসীন দল, পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি) এই কাজকে সমর্থন করবে। তবে এই সমস্যার শিকড় অনেক গভীরে গ্রথিত। এক্সপ্রেস ট্রিবিউন ব্লগে লেখা এক প্রবন্ধে আহমেদ আলি লিখেছেন [5]:

“বাস্তবতা হচ্ছে যারা ব্লাসফেমি আইন বাতিল করতে চায়, তাদের এক জটিল সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে। তাদের এক বুদ্ধিবৃত্তিক সমস্যা মুখোমুখি হতে হবে ও এক্ষেত্রে নিজস্ব সৃষ্টিশীলতার প্রয়োগ করতে হবে এবং তাদের ইজতিহাদ [6] নামক আন্দোলনের উত্থানকে আন্তরিক ভাবে মোকাবেলা করার মত ঘটনার মধ্য দিয়ে যেতে হবে। যেমনটা আমি আগেও বলেছি, এই বিষয়ে পাকিস্তানের উদারপন্থীদের ভিন্ন ধারার এক বর্ণনা প্রদান করতে হবে। ধর্মীয় ঐক্যতান ও স্বাধীনতা নিয়ে আলোচনার ক্ষেত্রে এমন এক ধর্মীয় ব্যাখ্যা প্রদান করতে হবে, যা সঠিক এবং শান্তিপূর্ণ ইসলামের ভিত্তি”।

আহমেদ খুবই সঙ্গত ভাবে বর্ণনা করেছে যে, পাকিস্তানের উদারনৈতিকতাবাদী এবং মানবতাবাদীরা নিজেদের ধর্মীয় সংস্কার থেকে এতটা দুরে সরিয়ে রেখেছে যে, তারা এখন আর সংস্কার প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করতে পারে না।

[7]

হজরত মুহাম্মদ (সঃ) অপমানের বিচার করার জন্য তৈরি করা ব্লাসফেমি আইনের পরিবর্তনের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের হায়দ্রাবাদের মুসলিম সম্প্রদায় প্রতিবাদ করছে। ছবি রাজপুত ইয়াসির-এর। কপিরাইট © ডেমোটিক্স (২৪/১২/২০১০)।

একই আবেগের ধারায় টিথ মায়েস্ত্রো ব্লগের বেনামী এক পোস্টে [8] লেখক লিখেছে:

“আইনের সংশোধন, প্রবল ভাবে ছড়িয়ে পড়া এক ক্যান্সারের চিকিৎসা শুরুর লক্ষণ। তবে যতক্ষণ না সেই সমস্ত উপাদানগুলো থামিয়ে দেওয়া যায়, যা আমাদের এ রকম এক আইন তৈরিতে উদ্বুদ্ধ করে, এর অপব্যবহার সমর্থন করে, ততক্ষণ আসিয়া বিবির ঘটনার মত ঘটনা ঘটতে থাকবে”।

যারা আইনে সংশোধন করার চেষ্টা করছে লেখক তাদের প্রথমে রাষ্ট্র এবং এর প্রতিষ্ঠানকে উন্নত করার আহ্বান জানান, যাতে এ রকম নির্মম আইন সংশোধন করা সম্ভব হয়।

“উদার অভিজাত শ্রেণীর সঠিক মনোভাব হওয়া উচিত, প্রথমে পাকিস্তানের মত জায়গায় আইনের সম্ভব্য প্রয়োগের ব্যাপারটি বোঝা এবং তাদের বিষয়টি উপলব্ধি করা উচিত যে, এখনই এই আইন বাতিল করা সম্ভব নয়। এর বদলে তাদের রাষ্ট্রকে শক্তিশালী করার দিকে মনোযোগ প্রদান করা উচিত, তাদের উচিত রাষ্ট্রে আইনের শাসনকে আরো সুদৃঢ় করা এবং সমাজে অন্য ধর্মীয় জনগোষ্ঠীর যে সমস্ত নাগরিকরা রয়েছে, তাদের প্রতি সহনশীল মনোভাবের প্রচারণা চালানো। যারা অন্যায়ভাবে কাউকে অভিযুক্ত করতে চায়, শক্তিশালী রাষ্ট্র তাদের শাস্তি প্রদান করতে পারে। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্র লোকজনের ভেতরে ধর্মীয় সহিংসতার ছড়ানোর জন্য ধর্মান্ধ ব্যক্তিদের জেলে পুরতে পারবে। কেবল ব্লাসফেমি আইনের শিকার ব্যক্তিরাই যে এর সুবিধা পাবে তা নয়, অন্যরাও এর সুবিধা পাবে।

ব্লাসফেমি আইনের দ্বারা সামাজিক ক্ষেত্রে যে সমস্ত জটিলতা সৃষ্টি করা যায়, তা হচ্ছে বিনা জটিলতায় অন্যের প্রতি ঘৃণা সৃষ্টি করা, যেমন দেখা যায় এক বিশেষ ধর্মীয় উন্মাদকে যে আসিয়া বিবিকে হত্যা করতে পারলে তার জন্য পুরষ্কার ঘোষণা করেছিল [9]। এই ঘটনা, বা এ রকম ঘটনা, উগ্রবাদীদের ধর্মের নামে হানাহানি এবং হত্যা করতে উৎসাহিত করবে।

বীনা সারোয়ার পাকিস্তানের এক অন্যতম সাংবাদিক, যিনি আইন বিশেষজ্ঞদের সাথে কাজ করেছেন এই বিষয়টি জানার জন্য যে, এ রকম অপরাধের ক্ষেত্রে পাকিস্তানের আইনে কোন শাস্তির প্রতিবিধান রয়েছে কিনা। তিনি তার পোস্টে [10] দেখাচ্ছেন যে, এ রকম ঘটনার ক্ষেত্রে পাকিস্তানের সংবিধান শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে। এ রকম অন্যায়ের ক্ষেত্রে শাস্তি হিসেবে জেল ও জরিমানার বিধান রয়েছে। এবং যাদের প্ররোচণায় এ রকম হানাহানির সূত্রপাত হয়, কোন কোন ঘটনায়, তাদের মৃত্যুদণ্ডের বিধান রয়েছে।

ব্লাসফেমি আইন সংক্রান্ত নিজস্ব মতামত এবং এ ব্যাপারে পাকিস্তানী ব্লগ জগৎে সাধারণ অনুভূতির সারাংশ তৈরির মাধ্যমে ওয়াইস আফতাব বর্ণনা করেছেন [11]:

অবশ্যই ঝগড়ার প্রেক্ষাপটে বুদ্ধিবৃত্তিক সমালোচনা এবং গালাগালির মধ্যে পার্থক্য রয়েছে, কিন্তু কারো সম্বন্ধে অশ্রদ্ধাবোধসহ বাক্য উচ্চারণ করার মত ঘটনার কারণে কাউকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা, অনেক বাড়াবাড়ি এক বিষয়। কেবল নামের সমালোচনা করার জন্য ব্লাসফেমি আইনে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড! যারা মানবাধিকারে বিশ্বাস করে, তাদের কাছে এই রকম শাস্তি অবশ্যই গ্রহণযোগ্য নয়।

পাকিস্তানের অনলাইন সম্প্রদায় দীর্ঘ দিন ধরে সামাজিক বাস্তবতায় ব্লাসফেমি আইনের নিষ্ঠুর প্রয়োগের ব্যাপারে নিন্দা জানিয়ে আসছে। এখন সময় এসেছে এই ক্ষেত্রে এক ব্যবহারিক পদক্ষেপ গ্রহণ করার, যা ধারাবাহিকভাবে, বাস্তবসম্মত পদ্ধতিতে এবং সত্যিকার অর্থে সামাজিক মানসিকতার পরিবর্তন আনতে সক্ষম, যার ফলে এই আইন সংশোধনীর প্রস্তাবনা, শুরুতেই প্রবলভাবে বিরোধিতার সম্মুখীন হবে না, এবং এভাবে, নতুন আইন চালুর আগে অর্থহীন হয়ে যাবে না।