সার্বিয়া: নোবেল শান্তি পুরষ্কার প্রদান অনুষ্ঠান নিয়ে বিতর্ক

নরওয়ের নোবেল শান্তি পুরস্কার প্রদান কমিটি এ বছর বিশ্ব শান্তিতে অবদান রাখার জন্য চীনা নাগরিক লিউ শিয়াওবোকে নোবেল পুরষ্কার প্রদান করে। কিন্তু তিনি ১০ ডিসেম্বরে নরওয়ের রাজধানী ওসলোতে পুরষ্কার প্রদান অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে পারেননি, কারণ তিনি শাস্তি হিসেবে প্রদান করা ১১ বছর জেলের মেয়াদ কাটাচ্ছেন।

কিছুদিন আগে, চীন সরকার সারা বিশ্বের অনেক দেশে একটি সরকারি কূটনৈতিক আবেদন প্রেরণ করে, এবং আহ্বান জানায়, যেন তারা নরওয়েতে অনুষ্ঠিত এই পুরষ্কার প্রদান অনুষ্ঠানে অংশ না নেয়। রাশিয়া, সার্বিয়া এবং ইউক্রেন সহ বিশ্বের ১৯টি দেশ নোবেল শান্তি পুরষ্কার প্রদান অনুষ্ঠানে উপস্থিত না থাকার সিদ্ধান্ত নেয়।

যখন প্রচার মাধ্যমে আনুষ্ঠানিক ভাবে এই সিদ্ধান্তের ঘোষণা প্রদান করা হয়, তখন সার্বিয়ার পরারাষ্ট্রমন্ত্রী ভুক জেরেমিচ তার প্রথম দিককার এক বিবৃতিতে বিস্তারিত ব্যাখ্যা প্রদান করেন কেন এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে:

অন্য সব সরকারের মত আমাদের সকল সিদ্ধান্ত জাতীয় আগ্রহ এবং রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয়তার বাস্তবতার উপর গ্রহণ করা হয়।

প্রধানমন্ত্রী মিরকো সেভেৎকোভিচ বলেছেন:

এটা সার্বিয়ার কৌশলী চাল, যার উদ্দেশ্য হচ্ছে চীনের সাথে কৌশলগত সম্পর্ক বজায় রাখা।

এনজিও, রাজনৈতিক দল, মূলধারা এবং নাগরিক প্রচার মাধ্যম সরকারের মনোভাব নিয়ে আলোচনা করেছে। তারা দাবী করছে যে মন্ত্রী জেরেমিচ যেন তার পদত্যাগ পত্র পেশ করে।

অন্য সব বিষয়ের সাথে পেসানিক নামক ওয়েব সাইট মানবাধিকার আইনজীবী সমিতির (লইয়ারস কমিটি ফর হিউম্যান রাইটস বা ইয়ুকম) এক বিবৃতি প্রকাশ করেছে: ইয়ুকম লিখেছে:

এ বছরের নোবেল শান্তি পুরষ্কার প্রদান অনুষ্ঠানকে বয়কট করে সার্বিয়া আরো একবার প্রমাণ করল যে তারা সত্যিকার অর্থে মানবাধিকারের জন্য লড়াই করা এবং আধুনিক, ইউরোপিয়, গণতান্ত্রিক সমাজের যে মূল্যবোধ, তার থেকে দেশটি অনেক দুরে রয়েছে।

১৯৯০ এর দশকের ভয়াবহ ঘটনাবলীর পর আমরা প্রদর্শন করা উচিত, যে সমস্ত লোকের অধিকার বিপন্ন এবং বিশ্ব শান্তির জন্য যারা নিজেদের জীবনকে ঝুঁকির মুখে ফেলে দেয়, তাদের সমর্থনে আমরা প্রথম সারিতে থাকব ।[…] সার্বিয়ার মানবাধিকার রক্ষার রাজনীতিকে শ্রদ্ধা করা উচিত, দেশটির এমন রাজনীতিকে গ্রহণ করা উচিত নয়, যা কেবল একটি সেতু নির্মাণ করে*, যা একজন মানুষের জীবনের চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ […]

* লেখকের ভাষ্য: চীন সরকার সার্বিয়াকে অল্প সুদে ঋণ প্রদান করেছে, যাতে সে বেলগ্রেডে একটি সেতু নির্মাণ করতে পারে, এই সেতুটি তথাকথিত “চীনা ব্রীজ” নামে পরিচিত।

এক সম্পাদকীয়তে ই-নোভিনে লিখেছে যে :

[…] যে সমস্ত দেশগুলো নোবেল শান্তি পুরষ্কার প্রদান অনুষ্ঠান বর্জন করেছে তাদের তালিকা থেকে একটি বিষয় পরিষ্কার যে, আমরা এখানে একটি অগণতান্ত্রিক শাসনের কথা বলছে, যেমন চীন, যার নিজেদের নাগরিকের সাথে সমস্যা রয়েছে, অথবা সেই সমস্ত দেশে, যাদের উপর বেইজিং-এর প্রচণ্ড প্রভাব রয়েছে।[…]

৮ ডিসেম্বরে সার্বিয়া মানবাধিকার রক্ষায় হেলসিঙ্কি কমিটির সদস্যরা একটি দরখাস্ত প্রকাশ করেছে, যেখানে সার্বিয়ার অনেক মানবাধিকার কর্ম, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক এবং রাজনীতিবিদ স্বাক্ষর করেছে:

এই দরখাস্তে আমরা যে সমস্ত মানবাধিকার রক্ষা কর্মী এবং গণতান্ত্রিক কর্মী স্বাক্ষর করেছি, তারা সার্বিয়ার হাজার হাজার নাগরিকের কথা বলছি, যারা অধীর আগ্রহে দেখার জন্য অপেক্ষা করে রয়েছে যে, তাদের দেশ দৃঢ়ভাবে ইউরোপীয় নীতিমালার প্রতি বিশ্বস্ত এবং সমসাময়িক বিশ্বের মূল্যবোধের প্রতি সর্বোচ্চ গুরুত্ব প্রদান করছে।
এ কারণে আমরা নিম্ন স্বাক্ষরকারীরা প্রবলভাবে আমাদের সরকারে এই সিদ্ধান্তের অনুমোদনের বিরোধীতা করি, যা কি না বিষয়টিকে এক অগণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের বৃত্তে নিয়ে যায়, যে সবের প্রতিনিধিরা লিউ শিয়াবোওকে প্রদান করা নোবেল শান্তি পুরষ্কার প্রদান অনুষ্ঠান বর্জন করতে বলে। এই মানুষটি দীর্ঘ সময় ধরে ধারাবাহিকভাবে এবং শান্তিপূর্ণ প্রক্রিয়ায়, চীনে মৌলিক মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করে যাচ্ছে। তিনি সভ্য এ পৃথিবীর শ্রদ্ধা অর্জন করেছেন।
এই দরখাস্তের মাধ্যমে আমরা আশা করি নোবেল কমিটি এবং বিশ্বের জনসাধারণ জানুক যে সার্বিয়ার অনেক নাগরিক সত্যিকার অর্থে সাম্প্রতিক সময়ে তাদের সরকারে যে লজ্জাজনক সিদ্ধান্ত নিয়েছে তা অনুমোদন কর না, তারা এই “রাজনৈতিক চুক্তির” কঠোর বিরোধীতা করে, যা ১৯৯০ সালের যুদ্ধের পূর্বে এবং পরে জাতীয়তাবাদী সার্বিয়া রাষ্ট্রের চরিত্র, এবং এই যুদ্ধ এবং স্বৈরতান্ত্রিক শাসকদের অন্য সব রক্তক্ষয়ী কর্মকাণ্ডের কারণে এবং “এক জাতী” নীতির কারণে-“জাতীয় আগ্রহের” নামে ব্যক্তিগত অধিকার দমন করা হয়েছে”-২১ শতকে সে দেশে যে কোন ধরনের দাসত্বের বিরুদ্ধে এত জোরে আওয়াজ তোলে, সেখানে একজন মানবাধিকার কর্মীকে জেলে পোরা হয় এবং তার পরিবার এবং সহকর্মীদের গৃহবন্দি করে রাখা হয়, যাতে তারা অসলোতে গিয়ে উক্ত ব্যক্তির হয়ে নোবেল পুরষ্কার গ্রহণ না করতে পারে।

বিলিচ, বেলগ্রেডের একটি দৈনিক পত্রিকা, এটি একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করেছে যার শিরোনাম “সরকার বয়কটের পক্ষে, তাদিচ তার বিপক্ষে”। এই বিষয়ে যে সমস্ত উচ্চপদস্থ সরকারি কমকর্তারা এর বিপক্ষে ছিলেন, তাদের উপর গুরুত্ব প্রদান করেছে এবং (ইউরোপকে বিস্তৃত করণ সমিতি (ইউরোপিয়ান এনলার্জমেন্ট কমিশন) এর মূখপাত্র স্টেফান ফুয়েশেল নামক ভদ্রমহিলার বিবৃতি উদ্ধৃত করেছেন:

এটি এমন একটি দেশের কাছ থেকে আশা করা হয়েছে, যে দেশটির ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে যোগ দেবার আকাঙ্খা রয়েছে, যাতে সে ইউরোপিয় ইউনিয়নের মূল্যবোধগুলো ভাগাভাগি করে নিতে পারে।

এই ত্রুটিপূর্ণ সিদ্ধান্ত কেবল যে রাষ্ট্রপতি তাদিচ এবং প্রধানমন্ত্রী জেরেমিচের মধ্যে বিভক্তির সৃষ্টি করেনি, একই সাথে তা পাঠকদের মধ্যে বিভক্তির সৃষ্টি করেছে, যারা এই প্রবন্ধের উপর ২৫০টির মত মন্তব্য করেছে। মূলত তারা বৈদেশিক নীতির প্রভাব নিয়ে আলোচনা করেছে।

নীচে কিছু মন্তব্য উপস্থাপন করা হল:

নেনাদরু::

[..] ইউরোপিয় ইউনিয়নের কোন রাষ্ট্রই এই অনুষ্ঠান বয়কট করার সিদ্ধান্ত নেয়নি। কেবল সার্বিয়া এবং তার “ইউরোপ-পন্থী” মন্ত্রী এটি বয়কট করেছে।[…] খুব বাজে, আমরা কি জানতে পারি জাতীয় রাজনীতির ধরন আসলে কি?

জেলে::

আমরা তাদের কাছ থেকে কোন সুবিধাটি পেয়েছি? যখন আমরা ইউরোপিয় ইউনিয়নের সদস্য হলাম তখন আমরা অন্যদের মত ভোট দিতে পারব।এখন তাদের প্রতি আমাদের কোন ধরনের প্রতিবন্ধকতা রয়েছে? তারা আনুষ্ঠানিকভাবে কসোভোর স্বাধীনতা প্রদানের জন্য আমাদের উপর চাপ প্রয়োগ করছে? আমাদের ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সাথে মিশে যেতে চাওয়া উচিত নয়, তারা আমাদের দেশে বোমা বর্ষণ করেছে এবং যুদ্ধকালীন সময়ে যে ক্ষতি করেছে তার ক্ষতিপূরণ প্রদান করেনি[…]

টিজেডটিটিজেড::

আমি জানি না কোনটা আমাদের জন্য ভালো, [অসলোতে] যাওয়া, নাকি না যাওয়া […] কিন্তু, চীন এখনো কসোভোকে স্বীকৃতি দেয়নি, কিন্তু ইউরোপিয় ইউনিয়ন তা করেছে।

সেরকো সেকলেজিক বি৯২ ব্লগের অতিথি লেখক হিসেবে তার পোস্টে মিলোস বোগিসেভিচ লিখেছেন:

[…] এখানে প্রশ্ন হচ্ছে যে ভবিষ্যত প্রজন্ম কি গর্বের সাথে এই বাস্তবতার উপর মনোযোগ প্রদান করবে যে, ২০১০ সালের মানবাধিকার দিবসে নোবেল পুরষ্কার প্রদান অনুষ্ঠান সার্বিয়া বর্জন করবে, নাকি তার জন্য তারা লজ্জিত হবে। হয়ত ইতোমধ্যে আজকের দিনটির জন্য আমরা লজ্জিত হব।

পুরষ্কার বিতরণি একদিন আগে, ৯ ডিসেম্বর, বৃহষ্পতিবার সন্ধ্যায়, সার্বিয়ার ওমবুডসম্যান বা ন্যায়পাল সাসা জানকোভিচ অনুষ্ঠান বর্জনের উদ্যোগকে স্থগিত করেন এবং সার্বিয়ার একজন স্বাধীন প্রতিনিধি হিসেবে অসলোতে যাবার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি এই উপলব্ধি করে, এই কাজটি করার সিদ্ধান্ত নেন যে. সার্বিয়া তার আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত পাল্টাবে না। এরপর জনতার চাপে প্রধানমন্ত্রী সেভেৎকোভিচ সরকারের পক্ষ থেকে জানকোভিচকে নোবেল কমিটি এবং লিউ শিওয়াবোকে তার ব্যক্তিগত অভিনন্দন জানাতে বলেন।

আলোচনা শুরু করুন

লেখকেরা, অনুগ্রহ করে লগ ইন »

নীতিমালা

  • অনুগ্রহ করে অপরের মন্তব্যকে শ্রদ্ধা করুন. যেসব মন্তব্যে গালাগালি, ঘৃণা, অবিবেচনা প্রসূত ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকবে সেগুলো প্রকাশের অনুমতি দেয়া হবে না .