বাংলাদেশ: গ্রামীণ কেলেঙ্কারি এবং তার চেয়েও বেশি

নোবেল বিজয়ী বাংলাদেশী ড. মুহাম্মদ ইউনুস। ছবি ফ্লিকার থেকে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম এর সৌজন্যে। সিসি বাই-এসএ।

এখন বাংলাদেশে সবচেয়ে আলোচিত বিষয় হচ্ছে নোবেল বিজয়ী ব্যক্তিত্ব ড. মুহাম্মদ ইউনুসের উপর আসা একটি অভিযোগ। এই অভিযোগে প্রকাশ যে, তিনি গ্রামীণ ব্যাংকের নামে আসা বিদেশী সাহায্য গ্রামীণ কল্যাণ নামে অন্য আর এক সহযোগী প্রতিষ্ঠানে সরিয়ে ফেলেছেন। গ্রামীণ কল্যাণের উদ্দেশ্য হচ্ছে, ঋণের আকারে এবং অনুদানের মাধ্যমে গ্রামীণ ব্যাংকের কর্মচারী এবং তাদের পরিবারকে অর্থিক সহায়তা প্রদান করা। ডেনমার্কের চলচ্চিত্র নির্মাতা টম হেইনেম্যান নির্মিত এক অনুসন্ধানমূলক তথ্যচিত্রের নাম “ফাঙ্গট আই মাইক্রোজেল্ড” বা “ক্ষুদ্র ঋণের জালে বন্দী” যা গত সপ্তাহের মঙ্গলবার নরওয়ের জাতীয় টেলিভিশনে (এনআরকে) প্রচারিত হয়।

হেইনম্যান বাংলাদেশে প্রচলিত ক্ষুদ্রঋণকে এক সমালোচনামূলক দৃষ্টিতে দেখেছেন। তিনি বলেছেন যে “অনেক ক্ষুদ্রঋণ গ্রহীতা এক সাথে কয়েকটি এ ধরনের ঋণ প্রদানকারী ব্যাংক বা সংগঠন থেকে কয়েক ধরনের ঋণ গ্রহণ করেছে এবং তারা সে সব ঋণ ফেরত দিতে গিয়ে বিপদে পরে গেছে”। এর ছাড়া তিনি নরওয়ের সাহায্য সংস্থা নোরাডের সংগ্রহশালায় রাখা কিছু নথিতে আচমকা চোখ বুলানোর সুযোগ পান, যেখানে বলা হয়েছে যে গ্রামীণ ব্যাংক দাতাদের প্রদান করা অর্থ দাতা সংস্থার অনুমতি ছাড়াই গ্রামীণ কল্যাণে পাঠিয়ে দিয়েছে, যাতে সরকারকে ৪০ শতাংশ কর প্রদান না করতে হয়। এক বিশেষ অনুসন্ধানে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় অনলাইন সংবাদ প্রকাশনা বিডিনিউজ২৪.কম এইসব গোপন নথি (পিডিএফ ফাইল) প্রকাশ করে দিয়েছে। স্থানীয় পত্রিকা এই সংবাদের উপর হামলে পড়ে এবং ব্লগাররা এই বিষয়ে বিভক্ত হয়ে যায়।

গ্রামীণ ব্যাংক এর উত্তরে জানায় যে তারা অন্যায় কোন কিছু করেনি।

আনহেয়ার্ড ভয়েস ব্লগের আসিফ গ্রামীণ ব্যাংকের আয়োজনের সংক্ষিপ্তসার সরবরাহ করেছে এবং তথ্যচিত্রের প্রভাব নিয়ে আলোচনা করেছে:

১. দাতা সংস্থা (সর্বোপরি নোরাড) গ্রামীণ ব্যাংককে বড় আকারে অর্থ মঞ্জুরি করেছে।
২. সূদ বা মূল টাকা ফেরত দেবার বদলে এই অর্থের ২ শতাংশ কর্মচারী কল্যাণ প্রকল্পে (এসএফ) জমা রাখা হয়েছিল।
৩. গ্রামীণ ব্যাংক নতুন আরোপ করা ৪০ শতাংশ করের ব্যাপারে শঙ্কিত ছিল. যা প্রাপ্ত এই অর্থের উপর প্রদান করতে হত এবং সে “কর্মচারী কল্যাণ প্রকল্পে” উপর মনোযোগ প্রদান করতে চেয়েছিল।
৪. কাজেই গ্রামীণ ব্যাংক, এক্ষেত্রে গ্রামীণ কল্যাণ (জিকে) নামক প্রতিষ্ঠানের সৃষ্টি করল, তাদের প্রচুর অর্থ প্রদান করল এবং এই ২ শতাংশ সুদে সেই অর্থ ফেরত দেবার ব্যবস্থা করে দিল।

নোরাডের সমস্যা হচ্ছে যে:

১. গ্রামীণ ব্যাংক তাদের এই বিশেষ এই উদ্দেশ্যের কথা নোরাডকে জানায়নি। বলা যায় ঘটনাক্রমে তারা এই বিষয়টি সম্বন্ধে জেনে ফেলে (এই বিষয়ে বিডিনিউজ২৪ সংবাদের কয়েকটি পিডিএফ ফাইল রয়েছে)

২. এসএএফের জন্য প্রদত্ত ২ শতাংশ অর্থের ব্যাপারে নোরাডের সাথে পারস্পরিক বোঝাপড়ার স্মারক স্বাক্ষর হয়েছিল গ্রামীণ ব্যাংক এবং বাংলাদেশ সরকারের সাথে, গ্রামীণ কল্যাণের সাথে নয়। কাজেই এটি এমন এক শূন্যতার সৃষ্টি করে যার, মধ্যে কারণে স্বস্তি বোধ করছে না।

এই তথ্যে চিত্রে দাবি করা হয়েছে যে প্রায় ১০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার অন্যত্র সরিয়ে ফেলা হয়েছে- তবে এসব কিছু সত্ত্বেও নরওয়ে দাবি করেছে যে ড: মুহাম্মদ ইউনুস দুর্নীতিপরায়ণ নয়- তবে এদিকে বাংলাদেশের প্রচার মাধ্যমে “ড: ইউনুস গরিবদের জন্য আসা ৭ বিলিয়ন টাকা অন্যত্র সরিয়ে ফেলেছে” এই রকম ভয়ঙ্কর সংবাদ প্রকাশিত হয়। যদিও গ্রামীণ ব্যাংক দ্রুত এই সমালোচনার জবাব প্রদান করে, কিন্তু ক্ষতি যা হবার তা হয়ে গেছে।

সাংবাদিক এবং ব্লগার মাসকায়াথ আহসানের “ নরওয়ের প্রচার মাধ্যমের এক অভ্যূত্থান, ঢাকায় নিহত ড. ইউনুস”- নামক পোস্টে ড. ইউনুসকে রক্ষা করার চেষ্টা করেছেন [বাংলা ভাষায়]:

অধ্যাপক ইউনুসের বিরুদ্ধে ইউরোপের অর্থ গ্রামীণের বোন সংস্থাতে স্থানান্তরের যে অভিযোগ উঠেছে, তা তার অর্থ বিষয়ক স্পর্শকাতরতার ফলাফল। ওই অর্থ দিয়ে ইউনুস ভূমধ্যসাগরের তীরে প্রাসাদ তৈরী করেন নি, সেটি গ্রামীণের সহযোগী সংস্থায় বিনিয়োগ করা হয়েছে। তবুও এটি দাতাদের সঙ্গে চুক্তির বরখেলাপ।

বাকি বিল্লাহ লিখেছে:

এটা একটা পদ্ধতিগত সংকট হতে পারে কিন্তু তার সাথে চৌর্যবৃত্তির সূত্র আবিস্কার করার মৌলিক কোন বিষয় আছে কি? প্রামাণ্যচিত্র নির্মাতা টম খুব সরলে এ প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন, তিনি বলেছেন, অনেক চেষ্টা করেও তিনি ইউনুস সাহেবের সাথে যোগাযোগ করতে পারেন নি। তিনি কিভাবে চেষ্টা করেছেন?

মাসকাওয়াথ আহসানের আরেকটা পোস্টে নেটপোকা নামের একজন মন্তব্য করেছেন:

দাতাদের দেওয়া টাকা সরিয়ে নেওয়ার যে অভিযোগ উঠেছে, তাতে কেবল ডঃ ইউনুসকেই দায়ী করা হচ্ছে। অথচ গ্রামীণ ব্যাঙ্কের একটি বড়সড় পরিচালনা পর্ষদ আছে, যাতে প্রতিনিধিত্ব করেছেন রেহমান সোবহানের মত ব্যক্তিগণও। অর্থ সরানোর দায় তো তাদের সকলেরই হওয়ার কথা!

আর দাতাদের দেওয়া টাকা থেকে এক টাকাও তিনি নিজের ব্যক্তিগত কাজে ব্যয় করেছেন কি? শুনেছি আজ পর্যন্ত তাঁর নিজের একটি মাথা গোঁজার জায়গাও নেই – থাকেন গ্রামীণ ব্যাঙ্ক ভবনের একটি ফ্ল্যাটে। অথচ তাঁকে এখন বলা হচ্ছে দুর্নীতিবাজ।

নরওয়ে এবং টেলিনর কেন ডঃ ইউনুসের পেছনে লেগেছে, তা সবাই জানে। তারপরও আমরা তাঁকেই ভিলেন বানাই।

এখানে জানা থাকা প্রয়োজন যে কয়েক বছর আগে ড:ইউনুস, নরওয়ের বৃহৎ টেলিফোন কোম্পানী টেলিনরের সাথে গ্রামীণ ফোনের ব্যবস্থাপনা পরিষদের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে এক সংঘাতে জড়িয়ে পড়েন (টেলিনরের বেশীর ভাগ শেয়ারের মালিক নরওয়ে সরকার)। গ্রামীণ ফোন ছিল টেলিনর এবং গ্রামীণ ব্যাংকের যৌথ উদ্যোগে সৃষ্টি এক কোম্পানী। ইউনুস বাংলাদেশের নেতৃস্থানীয় এবং লাভজনক এই টেলি যোগাযোগ প্রতিষ্ঠানটিকে সামাজিক ব্যবসার এক প্রতিষ্ঠান হিসেবে দাঁড় করাতে চেয়েছিলেন [ যেখানে লাভের অংশ প্রতিষ্ঠান থেকে না সরিয়ে আবার সেই প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করা হত], কিন্তু টেলিনর এই প্রস্তাবে রাজি হয়নি, পরবর্তী সময়ে নরওয়ের টেলিনর কোম্পানী শ্রম কেলেঙ্কারিতে ধরা পড়ে

শুভাশীষ দাস একটি বিস্তারিত বিশ্লেষণ পোস্ট করেছে [বাংলায়], সেখানে তিনি ব্যাখ্যা প্রদান করার চেষ্টা করেছেন, কেন ১২ বছর পর এই বিষয়টি প্রচার মাধ্যমে উন্মোচন করা হল:

২০১০ সালের মাঝামাঝি থেকে গ্রামীণ কল্যাণের অর্থ গ্রামীণ ব্যাংকে স্থানান্তরের জন্য সিডা, নোরাড আবার চাপ দেয়। ৬০৮ মিলিয়ন ক্রোনার (এর মধ্যে ৩০০ মিলিয়ন দেয় নোরাড, বাকিটা অন্যরা) গ্রামীণ ব্যাংক থেকে চলে গেছে গ্রামীণ কল্যাণে। অথচ ফেরত এসেছে মাত্র ১৭০ মিলিয়ন। বাকিটা এখনো গ্রামীণ কল্যাণে থেকে গেছে।

২২ আগস্ট ২০১০
গ্রামীণ ব্যাংক একটা ইমেইল দুটি ব্যাখ্যা জানায়-
গ্রামীণ ব্যাঙ্কের কর্মী আর সদস্যদের উন্নয়নের জন্য এই অর্থ স্থানান্তর।
গ্রামীণ ব্যাংক গ্রামীণ কল্যাণে কর ফাঁকি দেয়ার জন্য অর্থ স্থানান্তর করেনি। কারণ ১৯৮৩ সাল থেকে গ্রামীণ ব্যাংককে কোনো কর দিতে হয় না।

দরিদ্র এক বাংলাদেশি গ্রামীণ ব্যাংক থেকে ঋণ নিচ্ছে (কোন ধরনের জামানত প্রদান ছাড়াই)। ছবি ফ্লিকারের জীভস সিনক্লিয়ারের সৌজন্যে। সিসি বাই এনসি -এসএ।

সব শেষে শুভাশীষ কিছু যৌক্তিক প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন:

বাংলাদেশের ক্ষুদ্রঋণ সংস্থাগুলো ২০ থেকে শুরু করে ১০০% বা তারও বেশি সুদ নেয় গরিব মানুষের কাছ থেকে। ক্ষুদ্রঋণ দারিদ্র্যকে হালকার ওপর ঝাপসা প্রশমিত করে দীর্ঘমেয়াদি করে। উচ্চসুদের কারণে গরিব গরিবি মুক্ত হওয়ার সুযোগ পায় না। কিছু কামেল লোক হয়তো বেরিয়ে আসতে পারে। ঋণের যাঁতাকলে দীর্ঘমেয়াদে আটকে গেছে এমন লোকের পরিসংখ্যান জানা জরুরি। ক্ষুদ্রঋণ কেবল ভালো ভালো জিনিসগুলো পাবলিককে দেখায়, পেছনের বাজে দিকগুলো লুকিয়ে রাখে। এসব সমালোচকের দৃষ্টিতে দেখা প্রয়োজন। গ্রামের মানুষের টাকা নাই, তাদেরকে ঋণ দেয়া একটা ভালো ব্যবস্থা; কিন্তু ঋণের চক্রে ঢুকিয়ে দেয়া অমানবিক। [..] সরকারকে কর দিতে হয় না বলে দেশে প্রায় চার হাজারের মতো ক্ষুদ্রঋণ ব্যবসা। ২৫ থেকে ৩০ হাজার কোটি টাকার মতো ঋণ বিতরণ হচ্ছে প্রতি বছর। সহজে মুনাফা অর্জনের জন্য এর চেয়ে ভালো ব্যবসা আর নেই। সরকারের উচিত এদের উপর সর্বস্ব ভালো কথাগুলো খতিয়ে দেখা। আর নরওয়ে উদ্দেশ্যমূলকভাবে এই আচরণ করলে সেটারও বিহিত হওয়া দরকার।

আলোচনা শুরু করুন

লেখকেরা, অনুগ্রহ করে লগ ইন »

নীতিমালা

  • অনুগ্রহ করে অপরের মন্তব্যকে শ্রদ্ধা করুন. যেসব মন্তব্যে গালাগালি, ঘৃণা, অবিবেচনা প্রসূত ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকবে সেগুলো প্রকাশের অনুমতি দেয়া হবে না .