মরোক্কো: মহান সুফিবাদের পুর্নজাগরণ

মরোক্কোয় এখন ধীরে ধীরে আবার সুফি তরিকার পুনর্জাগরণের পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে এবং আর তা দেশটির পথে প্রান্তরে উপেক্ষিত হচ্ছে না, বিশেষ করে তরুণদের কাছে। লোনলি প্লানেটের একটি ব্লগ পোস্ট এই বিষয়ে সংবাদ প্রকাশ করছে:

সুফিবাদ ইসলামের মরমিয়া এক শাখা, যার দর্শন হচ্ছে মনের ভেতরে শান্তি নিয়ে আসা, সুফিবাদের দর্শন মূলত সামাজিক একতা এবং স্রষ্টার সাথে মিলে যাওয়া। মরোক্কোর অনেকে, সুফিবাদকে ইসলামের অন্যতম রক্ষণশীল দর্শন সালাফিবাদের একটি বিপরীত ধারা হিসেবে দেখে। সুফিবাদ কয়েক দশকে দেশটিতে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে এবং একই সাথে দেশটির আধ্যাত্মিক দর্শনের প্রয়োজনীয়তার উত্তর প্রদান করছে।

১২ শতকে দক্ষিণ মরোক্কোর বেশির ভাগ অংশে ইসলামকে ছড়িয়ে দেওয়ার পেছনে সুফিবাদকে চিহ্নিত করা হয়। ঘটনাক্রমে সুফি তরিকা বা ভ্রাতৃত্ব বন্ধন, উত্তর মরোক্কো এবং একই সাথে গ্রামের দিকে তার প্রভাব বিস্তার করে। চতুর্দশ শতকের শেষের দিকে সুফিবাদ মরোক্কোর রাজনীতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হয়ে উঠে। তিনশ বছর ধরে মরোক্কোর সংস্কৃতির এক উপাদান বা তারচেয়ে বেশী গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে থাকার পর সুফিবাদ, আরো কঠোর ইসলামপন্থী ধারার রাজনীতির ছায়ার মাঝে হারিয়ে যায়।

২১ শতকের শুরুতে ইসলামী মৌলবাদ সারা বিশ্বে দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। সুফিবাদের সহনশীলতা এবং প্রশান্তি, ইসলামে বাড়তে থাকা উগ্রবাদের হুমকি মোকাবেলার এক সম্ভাব্য অন্যতম মাধ্যম হিসেবে।

মরোক্কোর বাদশা ষষ্ঠ মুহাম্মদ, আলায়ুত রাজবংশের উত্তরাধিকারী। এই রাজবংশ ১৬৬৬ সাল থেকে মরোক্কো শাসন করে আসছে। এই রাজবংশ পুরো মাত্রায় সুফিবাদকে সমর্থন করে। রাজা ষষ্ঠ মোহাম্মদ তার শাসনামলে ডানপন্থী বিরোধীদের কাছ থেকে বেশ সমালোচনার মুখোমুখি হচ্ছেন। বর্তমান রাজার উদারনৈতিক এবং ধর্মনিরপেক্ষ শাসনের বদলে তারা অনেক বেশী ধর্মীয় প্রশাসন চাইছে ।

মার্গট বোয়ার-ড্রাই, যিনি ওয়েসলিয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্রী, তিনি এই বিষয়টি বিশ্লেষণ করছে।

“এখানে একইভাবে সুফিবাদ দেশটিকে রক্ষা করতে এগিয়ে এসেছে (অন্তত সরকারের মানসিকতাকে): মরোক্কোর সুফি ইসলাম অনেকটা একই রকম, এর স্বভাব উদারনৈতিক এবং সহনশীল, রাজা ষষ্ট মোহাম্মদ এর অধীনে ইসলামকে এভাবে প্রয়োগ করা হয়। আদর্শগত ভাবে যতই সুফিবাদ মরোক্কোয় জায়গা করে নেব, ততই কম লোক ধর্মীয় ব্যাপারে রাজার ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলবে”।

এমনকি যদি সুফিবাদ মরোক্কোর সরকারের একটি রাজনৈতিক উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত হয়, তারপরেও বিষয়টিকে অনেক তরুণ প্রজন্ম স্বাগত জানাবে, যারা ধর্মীয় উন্মাদনাকে বাতিল করে সুফিবাদের প্রতি আকর্ষিত হবে এবং আধুনিক উদারতার দিকে ধাবিত হবে।

যেমন উদাহরণ হিসেবে বলা, প্রতি বছর মরোক্কোয় বাৎসরিক সুফি উৎসব পালন হয়ে থাকে। মরোক্কোবোর্ডের এক লেখক গত এপ্রিলে অনুষ্ঠিত ফেজ উৎসবের বিস্তারিত বর্ণনা প্রদান করেছেন:

ফেজ সুফি সংস্কৃতি উৎসব (ফেজ ফেস্টিভেল অফ সুফি কালচার) সংস্থাটির মতে এই উৎসব ক্রমাগতভাবে প্রদর্শন করে যাচ্ছে যে মরোক্কো সুফিবাদের এক প্রাচীন ভূমি এবং এটি বিভিন্ন সংস্কৃতির মধ্যে আলোচনার সৃষ্টি করে, আবার একই সাথে তা পূর্ব এবং পশ্চিমের মধ্যে এক সেতুবন্ধন সৃষ্টি করে এবং একই সাথে তা মধ্যস্থতাকারী হিসেবে মরোক্কোর ভূমিকার প্রতীকে পরিণত হয়েছে, যে ভূমিকা মরোক্কো সবসময় পালন করে আসছে, বিশেষ করে আধুনিক ইতিহাসে।

ফেজ উৎসবের মত একটি উৎসব সারা বিশ্বের সঙ্গীত উপস্থাপন করে থাকে, কিন্তু মরোক্কো নিজেই বিভিন্ন উদ্ভাবনী সুরস্রষ্টার এক উর্বর ক্ষেত্র। মরোক্কোর তিনটি জনপ্রিয় সঙ্গীত ঘরানা হচ্ছে গানাওয়া, আইসসওয়া, এবং হামাদচা এবং তাদের প্রত্যেকটির ক্ষেত্রে নিজস্ব গায়কী এবং অনুশীলন রীতি রয়েছে।

জো টাঙ্গারি লিখেছে:

গানওয়া সঙ্গীতকার, মরমিবাদী এবং নৃত্যশিল্পীরা মানুষ এবং জিনের মধ্যে যোগাযোগ গড়ে তোলার এক সংযোগ সূত্র সরবরাহ করে, জিনদের দেখা যায়, যারা ধোঁয়া বিহীন এক আগুন যাদের রাগান্বিত না করা খুব গুরুত্বপূর্ণ। এখানে শব্দটি ব্যবহার করা হয় তা হচ্ছে “আমাদের জিন” এবং এক বিশেষ ধরনের জিন মুল্ক, মুল‌ককে বলা হবে (যার শাব্দিক অর্থ, ‘মালিক’) সেই সমস্ত লোকেদের অধিকার করতে, যারা তার পথের বাইরে চলে যায। গানওয়া উৎসবের অন্যতম এক উদ্দেশ্য হচ্ছে মুলকের সাথে আলোচনায় বসা এবং তাকে দুর করে দেওয়া- আত্মিক শুদ্ধতার জন্য এটি সুফিবাদের অনুসন্ধানের সাথে মিশে যায়। অউলেদ বামবারা একগুচ্ছ সুন্দর গানওয়া সঙ্গীত যা, গানওয়া উৎসব ফারজার সময়, অথবা বিনোদন প্রদানের সময় গাওয়া হয়।

গানওয়া আবহনের কিছু উদাহরণ, অথবা লিলা সঙ্গীত এখানে পাওয়া যাবে।

মরোক্কোর আরেকটি উল্লেখযোগ্য ঘরানা পরিচালনা করেন বশির আত্তার। জাজোকার এই ওস্তাদ সঙ্গীতজ্ঞ উত্তর মরোক্কোর জাজোকা নামক গ্রাম থেকে এসেছেন। মরোক্কোর সুলতান আত্তার পরিবারকে এই রাজ্যের সম্মানসূচক উপাধি প্রদান করেছে, এবং তারা সুলতানের জন্য সঙ্গীত পরিবেশন করে থাকে। আত্তার পরিবার বংশ পরম্পরায় প্রায় ১৩০০ বছর ধরে এ দেশের সঙ্গীত এবং ঐতিহ্য ধারণ করে আসছে।

সকল উদ্দীপনা সত্বেও মরোক্কোর একটি অংশ বিশ্বাস করে যে সুফিবাদের পুনরুত্থান ইসলামের মূল ধারাকে হটিয়ে দেবার এক কৌশল। ইদ্রিস আল ফায়েজ যিনি নিজেকে এক রক্ষণশীল সূফি ইমাম বলে পরিচয় দান করেন, তিনি সুফিবাদের গুরুত্বের ক্ষেত্রে নিজের অবস্থান পরিষ্কার করেন, “কিছু কিছু সুফি কিছু বিষয় উপেক্ষা করে, যেমন দুই বিপরীত লিঙ্গের মেলামেশা এবং সঙ্গীতের ব্যবহার”

এছাড়া, এটি প্রমাণিত যে সুফিবাদ মরোক্কোর ঐতিহ্যের সাথে গভীর ভাবে যুক্ত। এবং সুফিবাদের পুনর্জাগরণ অন্তত মরোক্কোর ইতিহাসের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা।

আলোচনা শুরু করুন

লেখকেরা, অনুগ্রহ করে লগ ইন »

নীতিমালা

  • অনুগ্রহ করে অপরের মন্তব্যকে শ্রদ্ধা করুন. যেসব মন্তব্যে গালাগালি, ঘৃণা, অবিবেচনা প্রসূত ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকবে সেগুলো প্রকাশের অনুমতি দেয়া হবে না .