- Global Voices বাংলা ভার্সন - https://bn.globalvoices.org -

জাপান: একজন অপরাধীর স্মৃতিকথা-দ্বিতীয় খণ্ড

বিষয়বস্তু: পূর্ব এশিয়া, জাপান, আইন, নতুন চিন্তা, নাগরিক মাধ্যম

এক নাম না জানা ব্লগারের লেখনীর প্রথম খণ্ডের [1] পরের অংশে, সে তার জেল জীবন এবং সমাজে ফিরে আসার ক্রান্তিকালীন সময়টির কথা বর্ণনা করছে।

[2]

ছবি মারহায়াটার, সিসি লাইসেন্স এর আওতায় ব্যবহৃত।


নীচের লেখনী মূল জাপানী ভাষায় রচিত রচনার বিভিন্ন অংশের সারাংশ এবং লেখকের অনুমতিক্রমে তা প্রকাশিত হল।

অস্থায়ী বন্দীশালার জীবন

প্রায় তিন মাস পুলিশের থানার এক কক্ষে রাখার পর আমাকে এক অস্থায়ী বন্দিশিবিরে পাঠানো হল।…

সেখানকার পরিবেশ পুলিশী থানার চেয়ে পুরোপুরি ভিন্ন ছিল। অনেকটা কারাগারের মত। আমাদের চারপাশ ঘিরে উঁচু বেড়া ছিল। তারা সাথে সাথে আমার কাছে কি আছে তা পরীক্ষা করে দেখল এবং আমার দেহ তল্লাশী চালালো। বিষয়টি সত্যিই খুব ভয়ঙ্কর। আমাকে পুরোপুরি নগ্ন করে ফেলা হল এবং তারা আমার শিশ্ন এবং পায়ু পরীক্ষা করে দেখল। তারা আমার পাছা নিয়ে পড়ে রইল না, কিন্তু তারা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে তা পরীক্ষা করে দেখল এবং যে কেউ আমার পাছা বা গুহ্যদ্বার দেখতে পেত। বিষয়টি আসলেই ছিল বেশ অপমানজনক এবং আমি এর আগে কখনোই এমনটা করিনি, এমনকি গোপন কোন স্থানেও নয়….।

এই প্রথম তারা আমাকে অন্য কারাবন্দীদের মত একই পোশাক পরাল। আমি এখনো মনে করতে পারি, সে সময় আমি চিন্তা করেছিলাম “আমি কি এতটা নীচে নেমে গিয়েছি?!”

তারা আমার জন্য একটা নাম্বার বরাদ্দ করল, যা কি না পুলিশ, স্বল্পমেয়াদী বন্দী শিবির এবং পরবর্তীতে কারাগারে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এরপর তারা আমার একটি কারা কক্ষে নিয়ে গেল। নাম্বার দেবার পর থেকে আমার নাম ধরে ডাকা বন্ধ হয়ে গেল এবং তার বদলে কেবল আমার নাম্বার ধরে আমাকে ডাকা শুরু হল, ঠিক গৃহপালিত পশুর মত…

যদিও আমার কক্ষটি সাতজন লোকের জন্য বানানো হয়েছিল, কিন্তু সেখানে দশজন লোক ছিল; কারাগারে বন্দীর সংখ্যা বেশি হয়ে যাওয়ার কারণে এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল।

কক্ষে প্রবেশ করার সাথে সাথে আমি উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলাম, কারণ এখানকার লোকজনকে পুলিশ থানার কারাগারের চেয়ে কঠিন মনে হচ্ছিল। আমি কি এখানে সহজ হতে পারব? ঠিক আছে… আমি মনে করি আমার কাছে কোন বিকল্প নেই…।

যেহেতু এটি একটা গোষ্ঠীবদ্ধ জীবন, তাই সেখানে অনেক নিয়ম রয়েছে এবং সেখানকার প্রতিটি কক্ষের একটি নিজস্ব চরিত্র রয়েছে। পরিষ্কার করা এবং ছোট ছোট কাজ করার ক্ষেত্রে অনেক সুনির্দিষ্ট আদেশ রয়েছে, আর যারা কারাগারে নতুন আসে পায়খানা পরিষ্কারের দায়িত্ব তাদের। এটা নির্ভর করে কখন একজন নতুন বন্দী আসবে তখন আপনি দিনে একবার পায়খানা পরিষ্কার করবেন কিন্তু আমাকে এক সপ্তাহ ধরে তা করতে হয়েছে…

এর আগেও আমি শুনেছিলাম যে যারা ধর্ষণ বা যৌন অপরাধীদের কারণে গ্রেফতার হয়, তারা কারাগারে গালমন্দ করা হয়, সেটি সত্যি। সেখানে এরকম একগাদা অপরাধী ছিল, সবচেয়ে খারাপ বিষয়টি ছিল তাদের জিনিষ চুরি করা হত, তাদের লাথি মারা হত অথবা তাদের নাক ভেঙ্গে দেওয়া হত… একটি বন্দি শিবির সত্যি একটি ভয়ঙ্কর জায়গা।

প্রথম দেখাই একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এবং যদি আপনি এমন একজন হন যাকে দেখে মজা করা যায়, তাহলে আপনি তাদের পীড়নের শিকার হবেন। অন্য কথায় বলা যায়, যেহেতু তাদের কোন কিছু করার নেই, তাই বিষয়টি স্বাভাবিক যে ঘটনাগুলো এরকমই ঘটে। এখানে লোকজন যা বলে বা করে তা প্রথামিক স্কুলে পড়া বাচ্চাদের আচরণের সাথে খুব একটা পার্থক্য থাকে না। আমি নিজেও খুব বোকার মত কিছু কথা বলতাম, অনেকটা আমার প্রাথমিক স্কুলের সময়কার দিনের মত। আমি নিজে কাউকে উত্ত্যক্ত করিনি, নিজেকে উত্যক্ত হতে দেইনি।

আমি যতদুর মনে করতে পারি, আমার কক্ষে বাস করা লোকেরা এই সমস্ত অপরাধ করত। কারো শরীরে জখম করা, ডাকাতি, মাদক সংক্রান্ত অপরাধ, ডিভিডির কালোবাজারী, ধর্ষণ, যৌন নিপীড়ন, কাউকে আঘাত করার উদ্দেশ্য কাজ করা, অগ্নি সংযোগ, অবৈধ জুয়া খেলা, অপ্রাপ্তবয়স্ক পতিতার সাথে মিলিত হওয়া, জাল কাগজ তৈরি করা, প্রতারণা, নকল করা, ডাকাতি, ব্লাকমেইল, হুমকি, জোর করে কারো ব্যবসায় বাঁধা প্রদান করা, অবৈধ অনুপ্রবেশ এবং বন্দুক নিয়ন্ত্রণ আইন ভঙ্গ করা…

কারাগারে প্রতি দুইদিনে একবার ব্যায়ম করার রীতি ছিল, যদিও তা বাধ্যতামূলক ছিল না। তা কক্ষের বাইরে গিয়ে করতে হত। যাকে ব্যায়াম করা বলা হত, আদতে এর মানে ছিল ৫০ জন লোক একটি গোল বৃত্তের মধ্যে প্রায় ২০ মিনিট ধরে একটা ভবনের ২০ বর্গমিটার সরু জায়গা ধরে ধরে হাঁটা, যেখানে প্রায় কোন সূর্যের আলো পৌঁছায় না।

কোন দৌড়ানোর মত কোন বিষয় নেই, কোন কথাবার্তা নেই। এখানকার প্রতিটি সময় আলাদা, তবে ওই ২০ মিনিটের মধ্যে আমাদের নখ কাটার অনুমতি প্রদান করা হয়। যেহেতু সেখানে অল্প কয়েকটি নখ কাটার যন্ত্র রয়েছে, কাজেই যখনই ব্যায়ামের সময় শুরু হয় সাথে সাথে ঘোষণা করা হয়, যে ব্যক্তি দ্রুত দৌড়ে নখ কাটার যন্ত্র যার দায়িত্বে আছে তার কাছে যেতে পারবে সেই নখ কাটতে পারবে।

যেহেতু নখ কাটার যন্ত্র এরপর অনুশীলন কেন্দ্রের কোনায় রাখা হয়, কাজেই বিষয়টি সত্যি বিরক্তকর। যারা বিশেষ কারণে অবরুদ্ধ কক্ষে থাকত, তারা তাদের অনুশীলন করার সময়ে ছাদের উপর একটা খাঁচা দিয়ে তৈরি জায়গায় যাকে বলা হয় “পাখির খাঁচা” সেখানে ব্যায়াম। আমি নখ কাটার যন্ত্রটিকে পাবার জন্য লড়াই করা পছন্দ করিনি, আমি বিশেষত বাইরের দৃশ্য দেখাকে পছন্দ করতাম যা সত্যিই মনোমুগ্ধকর। আমি কেবল একটা বাইরের সামান্য একটা অংশ দেখতে পেতাম। তবে যে শহরটিকে আমি চিনি তাকে দেখ এবং ট্রেনগুলোকে চলতে দেখে আমার ভেতরে চার দেয়ালের বাইরে যে স্বাধীনতা তার অনুভুতি জেগে উঠত।

কারাগারে বন্দি থাকার সময় আমি এটা শিক্ষা লাভ করেছিলাম যে সত্যিকারের ইয়াকুজারা সৎ ব্যক্তিদের আঘাত করে না এবং অন্যদের যত্ন নেয়। চোর এবং ঠগরা অসৎভাবে কাজ করে এবং তারা উগ্র এবং শিশু সুলভ আচরণ করে। বিস্ময়করভাবে টোকিওর জেলখানায় অনেক উত্তর কোরিয়ার ইয়াকুজা ছিল। সেখানে এ রকম অনেক ঠগ বন্দী হয়ে ছিল এবং আমি তাদের ঘৃণা করি।

আমি অনেক গোপনীয় খবর অনেক শুনেছি এবং তারা সত্যিই এতে অনেক কৌতুহলী। বেতনভুক কর্মচারী হিসেবে কেবল আমার এ রকম অভিজ্ঞতা রয়েছে। সেখানে এমন অনেক বিষয় ছিল যা আমি জানতাম না।

সে সময়ের আগে পর্যন্ত আমি ভাবতাম যে আমার জীবন স্বাভাবিক কিন্তু আমি শিখলাম যে “স্বাভাবিক” জীবন বলে কিছু নেই। সবার প্রতিদিনের জীবনই স্বাভাবিক।

এক বছর পরে আমাকে কারাগারে প্রেরণ করা হয়। আমাকে সাড়ে ছয় বছরের জেল দেওয়া হয় এবং এটা ছিল আমার জন্য এক ধাক্কা। কেন্দ্রে যে ব্যক্তিটি ছিল সে আমাকে সান্তনা দিচ্ছিল, আপনার অপরাধের কথা বিবেচনা করলে বলা যায়, তুমি সবকিছু গুবলেট পাকিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু এমনকি ভালো আচরণ করলে তোমার কেবল তিন বছর দশ মাস সাজা হবে। কাজেই এটা মনে হচ্ছে অনেক লম্বা সময়…..

আমি আবেদনের মত একটা বিষয়ের মাঝে আমি ঝুলে গেলাম অথবা গেলাম না, কিন্তু আমার বাবা-মা তা তীব্রভাবে চাইছিল, আমি আবেদন করার সিদ্ধান্ত নিলাম। এই সময় সিদ্ধান্ত নেওয়া হল আমাকে টোকিও জেলে পাঠানো পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিল।

প্রতিটি বিচারের প্রথমিক পর্বে সাধারণত স্থানীয় প্রশাসনিক এলাকা অথবা জেলায় অনুষ্ঠিত হত, কিন্তু যেহেতু উক্ত এলাকার আপীল আদালত টোকিওতে, তাই মামলাটি টোকিও-তে স্থানান্তরিত করা হল।

কাজেই একটি কক্ষে জীবন কাটানোর সেই আনন্দদায়ক সময়টা শেষ হয়ে গেল। নতুন কারগারে আমি একটি মাত্র কামারায় থাকার আবেদন জানালাম। কিন্তু তা প্রদান করতে অস্বীকার করা হল এবং আরো একবার তারা ভীড়ে ভর্তি একটি কামরায় রেখে দিল….

টোকিও কারগার অন্য সব কারগার থেকে ভিন্ন ছিল, যেহেতু তার কাঠামোটি ছিল নতুন। এটি ছিল বহুতল একটি ভবন এবং শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত, আর সেখানে কামরা গরম করার ব্যবস্থা রয়েছে।

জেল জীবন ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে কঠিন সময় ছিল পুরোপুরি অচেনা লোকেরা সাথে বাস করা।

সেখানকার অপরাধীরা সাথে প্রথমবার সাক্ষাৎ মানে মানে আমার মত একজন লোকের জন্য সমানে আসন্ন বিপদ, যে কিনা একদল লোকের মাঝে অস্বস্তি বোধ করে, যেখানে এর চেয়ে যন্ত্রণাদায়ক বিষয় আর কিছুই নেই। এমনকি বিষয়টি উপলব্ধি না করেই, আমি অনেক চাপ সহ্য করে ক্রমাগত অন্য লোকদের মাঝে বাস করে।

আমি প্রায় হতাশ হয়ে পড়তাম। আমি নিজেকে বলতাম যে এটাও শাস্তির একটা অংশ এবং আমাকে এর মধ্যে বাস করতে হবে। তবে অনেকবারই এই সমস্ত স্বার্থপর লোকের কারণে আমার পাগল হয়ে যাবার মত দশা হয়েছিল। যদি একজন স্বাভাবিক মানুষের দৃষ্টিতে দেখা যায় তাহলে আমি সেই সব মানুষদের দলে।

একদিন আমাকে দেখতে আসা আমার মাকে, যখন আমি কর্তব্যরত প্রহরীকে বলতে শুনলাম “আপনি কি আমার ছেলেকে একটি নির্জন কামরায় থাকার ব্যবস্থা করতে পারেন?” তখন আমার চোখ দিয়ে এক ফোটা অশ্রু বের হয়ে এলো।

এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে আমার পরিবারও এই ঘটনার স্বীকার করে…
এরপর আমি আর কোনদিন আমার পিতামাতার কাছে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে না….।

চার দেওয়ালে বাইরে [3]

চারবছর তিনমাস কারাগারে কাটানোর পর, আমি স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এলাম। কিন্তু প্রথম দুই মাস আমার মাথা একেবারে ফাঁকা ফাঁকা লাগত, বিশেষ করে যখন আমি শহরে বের হতাম। এমনকি এটা এমন একটা শহর, যাকে আমি আমার হৃদয় দিয়ে চিনি। এছাড়াও আমি অনুভব করতে পারছিলাম যে আমি আমার মস্তিষ্ক এই সমস্ত তথ্যগুলোকে বিশ্লেষণ করতে পারত না যে সমস্ত তথ্য গুলো চোখ দেখছে।

কারণ লম্বা সময় ধরে আমার এমন একটা জায়গায় বাস করেছিলাম প্রায়শই তারা বলে যে, কারণ জেলে আপনাকে কি করতে হবে তা বলা হয়েছে এবং সেখানে আপনাকে কিছু বিশেষ কাজ করতে পারবেন, সেখানে আপনি স্বাধীনতা হারাবেন। তবে আমি মনে করি আমার ক্ষেত্রে এ রকমটি ঘটেনি.. তবে যদিও অতীতের সাথে তুলনা করি তাহলে বলা যায় আমি অনেক কম সক্রিয়।

এছাড়াও আমি ভাবলাম যে আমি অল্প সময় হল বের হয়েছি, তাই আমাকে এসব সহ্য করে নিতে হবে, তবে বিষয়টি সে রকমভাবে ঘটেনি। এমনকি এখনো, আমি সেই সমস্ত হালকা খাবার এবং কাপ নুডুলস কিনি যা আমি জেলখানায় খেতাম। যদিও সেগুলো সাধারণ মানুষের জন্য তৈরি, তারপরেও সেগুলো আমার জন্য জেলখানার স্বাদ বয়ে আনে।

একটি দাগ [4]

যখন আমি অনুভব করি একজন অপরাধী হয়ে আমি কি হারিয়েছি, আমি বুঝতে পারি, আমি অনেক কিছু হারিয়েছি। আমার বন্ধুরা, আমরা প্রেমিকা, আমার চাকুরি, আমার সামাজিক মর্যাদা, বিশ্বাস, অর্থ, সময় সবকিছু। যদি আমি এর সবগুলোকে হিসেব করি তাহলে দেখা যাবে ক্ষতির কোন পরিসীমা নেই।

আমি সত্যিকার অর্থে আমার পরিবার এবং সেই সমস্ত বন্ধুদের প্রতি কৃতজ্ঞ, যারা এখনো আমার কাছে আগের মতই আছে, যারা তাদের বিশ্বস্ততার হাত আরো দৃঢ় করেছে, আমি তাদের জন্য কি করতে পারি?