ভারত: ই-গভার্নেন্স উদ্যোগগুলো কি স্বচ্ছতা আর জবাবদিহিতা এনে দিচ্ছে?

ভারতে অনেক সরকার থেকে নাগরিক (জিটুসি) ই-গভার্নেন্স উদ্যোগ নেয়া হয়েছে এবং এদের সংখ্যা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। অনেক সরকারী এজেন্সি আর সেবাদানকারী সংস্থা এখন সামাজিক মিডিয়া এবং অন্যান্য তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্লাটফর্ম তৈরি করছে বিভিন্ন সেবা দেবার জন্যে যাতে নাগরিকরা আরও উদ্বুদ্ধ হয় এবং সরকারের স্বচ্ছতা আর জবাবদিহিতা সম্পর্কে আশ্বস্ত হয়।

উদাহরণস্বরূপ সাম্প্রতিক কালে আমরা দেখেছি যে দিল্লি ট্রাফিক পুলিশ (ডিটিপি) ফেসবুকের ব্যবহার করছে ট্রাফিক আইন অবমাননা সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ করতে। ইন্দোর পুলিশ কর্তৃপক্ষ ব্লগ, টুইটার ও মোবাইল অভিযোগ ফর্ম ব্যবহার করছে, এবং এর সাথে পুলিশ স্টেশনের একটি গুগল ম্যাপ এবং এই অঞ্চলে অপরাধগুলোকে তালিকাবদ্ধ করতে একটি ডিজিটাল অপরাধ ম্যাপের উদ্যোগ নিয়েছে।

ইন্দোর পুলিশের ডিজিটাল অপরাধ ম্যাপ উদ্যোগ

ইন্দোর পুলিশের ডিজিটাল অপরাধ ম্যাপ উদ্যোগ।

মহারাষ্ট্র পুলিশ ডিপার্টমেন্ট ‘তুরান্ত চভিস’ (২৪ ঘন্টার মধ্যে) নামে একটি এসএমএস-দ্বারা পরিচালিত অভিযোগ ব্যবস্থাপনা সিস্টেম (সিটিএস) তৈরি করেছে যা জনগণের করা অভিযোগ সম্পর্কে ২৪ ঘন্টার মধ্যে তাদের জবাব জানাবে এবং সমস্যার সমাধান করবে ৩০ দিনের মধ্যে। নাসিক রুরাল পুলিশ ডিপার্টমেন্ট নামে একটি বিভাগ ২০০৯ সালের মন্থন অ্যাওয়ার্ডস ও জয় করে তাদের প্রযুক্তি ব্যবহারের অভিনবত্বের জন্যে এবং তাদের তুরান্ত চভিসের সেবার ৯৬% সাফল্য অর্জনের জন্যে।

ভাল গভার্নেন্সের জন্যে শুধু পুলিশ বিভাগই প্রযুক্তি ব্যবহার করছে না। অনেক প্রাদেশিক সরকার তাদের ই-গভার্নেন্স উদ্যোগকে জোড়াল করছে অন্তর্জালিক প্রযুক্তি সহকারে বিশেষ করে নাগরিকদের সমস্যা দূরীকরণে। সংযোগ হেল্পলাইন হচ্ছে একটি কেন্দ্রীভুত একটি একমুখী সমস্যা দূরীকরণ পদ্ধতি যা উড়িষ্যা প্রদেশে ব্যবহৃত হচ্ছে। নাগরিকরা তাদের সমস্যা নিবন্ধিত করতে পারে একটি খরচাবিহীন ফোন নম্বর, ফ্যাক্স বা ইমেইল ব্যবহার করে, এবং তাদের গ্রামের সংযোগ হেল্পলাইন পোর্টাল এর মাধ্যমে। তারা পরবর্তীতে তাদের অভিযোগ দূরীকরণে নেয়া পদক্ষেপগুলো কোন পর্যায়ে আছে সেটা সম্পর্কে জানতে পারবে এই পোর্টালের মাধ্যমে। উত্তর প্রদেশের ঝাঁসিতে একটি টেলিফোনভিত্তিক সমস্যা দূরীকরণ সিস্টেম চালু হয়েছে যার নাম ঝাঁসি জন সুবিধা কেন্দ্র। মধ্যপ্রদেশ সরকার তাদের ওয়েবসাইটে একটি অনলাইন সমস্যা নিবন্ধন সেবা চালু করেছে। এই সাইট প্রত্যেকটি নিবন্ধিত সমস্যা আলাদাভাবে অনুসরণ করার সুযোগ দেয় এবং কি পরিমাণ অভিযোগ এসেছে এবং সেগুলো দুর করা হয়েছে সে সম্পর্কে পরিসংখ্যান দেখায়।

অন্যান্য ডিপার্টমেন্ট যেমন রেলওয়ে এবং কর কর্তৃপক্ষ তাদের কিছু মুখোমুখি সেবাকে অনলাইন সেবায় রুপান্তরিত করেছে। এর মূলে রয়েছে নাগরিকদের জীবন সহজ করা এবং দুর্নীতি কমানো। নাগরিকরা এখন অনলাইনে করের রিটার্ন জমা দিতে পারবে এবং রেলওয়ে টিকেট কিনতে পারবে।

এই সব উদ্যোগই সুবিধাজনক, সংযুক্তকারী, স্বচ্ছতা আর জবাবদিহিতার প্রতিশ্রুতি দেয়। তবে তারা কতটুকু সফল? তারা কি প্রভাব ফেলেছে? তারা কি সত্যি সরকারের স্বচ্ছতা আর জবাবদিহিতা বাড়ানোর লক্ষ্যটিতে পৌঁছুতে পেরেছে? দুর্ভাগ্যবশত: আমরা মাঠ পর্যায়ে এইসব উদ্যোগের প্রভাব সম্পর্কে তেমন কোন মূল্যায়ন দেখিনি বিশেষ করে স্বচ্ছতা আর জবাবদিহিতা বাড়ানোর ব্যাপারটিতে। এর ফলে সন্দেহের জন্ম নেয় যে এদের কোন কোন উদ্যোগ লোক দেখানো – সাজানো উদ্যোগ যার কোন কার্যকারিতা নেই্।

উদাহরণস্বরূপ, অভিযোগ অনুসরণ পদ্ধতির কথা ধরুন। যখন একজন নাগরিক কোন অভিযোগ দাখিল করে এবং তা অনুসরণ করার চেষ্টা করে, সে একটি বার্তা পায় যে অভিযোগটি “বিবেচনাধীন আছে”। এটি একটি দ্রত জবাব, কিন্তু এর মানে আসলে কি? বিশেষ করে যখন অভিযোগকারী একই বার্তা বার বার দেখে কোন প্রতিকার ছাড়া। এই ক্ষেত্রে সেই নাগরিক তার হতাশাও জানাতে পারে না, কারন সামনা সামনি কোন কিছু আর হয় না।

সম্প্রতি, অনলাইন রেডিও বুকিং পদ্ধতি নিয়ে একটি অভিজ্ঞতা আমাকে এই সব উদ্যোগ সম্পর্কে সন্দিহান করে তুলেছে। এটি সত্যি যে অনলাইন রেলওয়ে বুকিং পদ্ধতি আসাদের জীবনকে সহজ করেছে। কাউন্টারে আর লাইন দিয়ে দাড়াতে হয় না এবং কোন এজেন্ট বা দালালকে বুকিং নিশ্চিত করার জন্যে টাকা দিতে হয় না। তবে, একটি বাতিল হওয়া টাকার রিফান্ড চাইতে গিয়ে দেখেন, আপনি বুঝবেন কত ধানে কত চাল। গত জানুয়ারি মাসে আমি যে ট্রেনে করে যেতে চেয়েছিলাম তা ১০ ঘন্টা দেরী করে ছেড়েছে। তাই আমি টিকেট বাতিল করে দিয়েছিলাম স্টেশনে সময় নষ্ট করার বদলে (নিয়মে আছে যে তিন ঘন্টার বেশী দেরীতে ট্রেন ছাড়লে পুরো টাকা ফেরত পাওয়া যাবে)। তবে আমি টিকেট স্টেশনে বাতিল করতে পারি নি। কারন অনলাইনে বুক করা টিকেট শুধু অনলাইনের মাধ্যমেই বাতিল করা যাবে।

অনলাইন রিফান্ড আবেদন করার পর আমি সাথে সাথেই একটি বিনয় সহকারে মেইল বার্তা পাই যে আমার টিকেট বাতিল ও টাকা ফেরতের প্রক্রিয়া চলছে এবং আমি ইচ্ছা করলে অনলাইনে আমার আবেদনের অগ্রগতি জানতে পারব। কয়েক মাস পরে আমি মোট টিকেট খরচের ৫০% ফেরত পাই এবং অনলাইন স্ট্যাটাসে লেখা হয় মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। কিন্তু মাত্র ৫০% কেন যখন নিয়মে লেখা আছে আমি ১০০% ফেরত পাব? এর কোন উত্তর নেই। আমি বেশ কবার মেইলে জানতে চাওয়ায় আমি বিনয় সহকারে উত্তর পাই যে আমার মেইলকে সংশ্লিষ্ট বিভাগে পাঠানো হয়েছে। কিন্তু এ্ পর্যন্ত, বিনয় সহকারে সেই মেইলগুলো ছাড়া আমার সমস্যা সম্পর্কে কোন তথ্য পাই নি। তাদের হেল্প ডেস্ক, যদিও সাহায্যের মনোভাব দেখিয়েছে, এই সমস্যার সমাধান দিতে পারে নি – কারন তাদের কোন ক্ষমতা নেই। তাদের কোন ধারণাও নেই এ বিষয়ে কার সাথে কথা বলা যাবে বা কে এর জন্যে দায়ী। এছাড়াও, আমার হাত বা বাধা কারণ অনলাইন বিক্রির সমস্যাগুলো অনলাইনেই সমাধা করতে হবে। তাই রেলওয়ে অফিসে গিয়ে কারও সাথে সাক্ষাৎ করে এটার সমাধান সম্ভব নয়।

এই ধরণের উদাহরণগুলো মানুষকে সরকারী বিভাগগুলোর ই-গভার্নেন্স আর জি২সি সংক্রান্ত লম্বা কথাগুলো সম্পর্কে সন্দিহান করে ফলে তাদের স্বচ্ছতা আর জবাবদিহিতার প্রতিশ্রতি নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। তবে নিশ্চয়ই এটা বলছি না যে এই সব উদ্যোগগুলোকে আমরা স্বাগত জানাচ্ছি না। এগুলো অবশ্যই সঠিক দিকে পদক্ষেপ। কিন্তু মনে রাখতে হবে শুধুমাত্র প্রযুক্তি এবং টুলস চালু করেই দায়িত্ব শেষ হয় না। সরকারের এদেরকে ঠিকভাবে কাজে লাগাতে হবে। এছাড়াও উচিৎ এসব উদ্যোগকে অনুসরণ করা ও মূল্যায়ন করা, শুধু মাত্র সরকারী কর্তৃপক্ষই নয়, বরং নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদেরও তা করতে হবে। তাহলে তারা সরকারকে চাপ দিতে পারবে স্বচ্ছতা আর জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে।

আলোচনা শুরু করুন

লেখকেরা, অনুগ্রহ করে লগ ইন »

নীতিমালা

  • অনুগ্রহ করে অপরের মন্তব্যকে শ্রদ্ধা করুন. যেসব মন্তব্যে গালাগালি, ঘৃণা, অবিবেচনা প্রসূত ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকবে সেগুলো প্রকাশের অনুমতি দেয়া হবে না .