গত সপ্তাহে বিশ্বের নজর কেড়েছে যে খবরটি, তা হল গত ১১ই সেপ্টেম্বর, ২০০১-এর হামলার বর্ষপূর্তি উপলক্ষ্যে মার্কিন যাজক টেরি জোন্সের পরিকল্পিত কোরান দাহ দিবস করার উদ্যোগ। ২০০০ সাল এর শেষের দিকে প্রকাশ্যে ইসলাম-এর সমালোচনা এবং প্রদর্শনের জন্য কুখ্যাতি অর্জন করা, ফ্লোরিডার গেইন্সভিল-এ অবস্থিত, ডাভ ওয়ার্ল্ড আউটরিচ সেন্টার-এর প্রধান হলেন টেরি জোন্স। প্রেসিডেন্ট ওবামা সহ অনেকেই এই উদ্যোগের নিন্দা করা সত্ত্বেও যাজক জোন্স, ৯ই সেপ্টেম্বর, ২০১০-এ সেই পরিকল্পনা বাতিল করা পর্যন্ত, পূর্ণোদ্যমে এগিয়ে চলেছিলেন, যা প্রচন্ড বিতর্কের সৃষ্টি করেছিল।
বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের ব্লগাররা এই বিতর্কে অংশগ্রহণ করেন এবং ফেসবুকে এই সম্পর্কিত কিছু গ্রুপ আরো উত্তেজনা সৃষ্টি করে। দক্ষিণ এশিয়ার ব্লগাররাও এই বিষয়ে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন এবং আমরা তাদের কিছু মতামতের দিকে নজর দেব:
ভূটান:
পাসু লিখছেন:
মাত্র ৫০ জনের মত সমর্থক সহ ফ্লোরিডার এক ছোট্ট সঙ্ঘের কোন এক যাজক জোন্স, তার একার বক্তব্য বিশ্বের লক্ষাধিক মানুষের মনে প্রভাব ফেলেছে. [..]
আমি তখন ড্রুকগেল উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়ি, যখন টুইন টাওয়ার ভেঙ্গে পড়ল এবং আফগানিস্তানে যুদ্ধের সূত্রপাত হল; আজ, নয় বছর পরে, বহু লোক মারা গেছেন কিন্তু আমরা কি পেয়েছি? ৯/১১ মনে রাখার জন্য আরও ভাল উপায় থাকা উচিত!
বাংলাদেশ:
আনহার্ড ভয়েস ব্লগ-এর আসিফ প্রশ্ন তুলেছেন:
এখানে একটি প্রশ্ন বিবেচনা করা যাক …, যখন এক গীর্জার যাজক কোরান পোড়ানোর জন্য তৈরী হচ্ছেন, তখন সমস্ত খ্রীষ্টানদেরই কি কোরান দাহকারী গোঁড়া হিসাবে গণ্য করা ঠিক হবে- যেভাবে ইসলাম এই দেশের চরমপন্থীদের দ্বারা নিন্দিত?
যত ৯/১১ এগিয়ে আসছে, সংবাদমাধ্যমে এই বিতর্ক দানা বাঁধছে। আমি এই দেশ ছেড়েছি ৬ বছর হয়ে গেল কিন্তু প্রতিবার এখানে এসে আশ্চর্য হই যে কিভাবে রাজনীতি ও সংবাদমাধ্যম প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির দ্বারা অপহৃত হয়। বিশ্বের গণমাধ্যমে মনে হয় সারা পালিন, তাঁর কন্যা, ওই যাজক, সন হ্যানিটির মতো লোকজনেরই আধিপত্য।
প্রবাসী ব্লগার জেরোম ডি'কোস্টা যাজক জোন্সের চমককে অখ্রীস্টিয় বলে অভিহিত করেছেন। কোরাণ দাহ করার পরিকল্পনা সম্পর্কে তাঁর কিছু পর্যবেক্ষণ:
- যাজক এবং তাঁর গীর্জার সদস্যদের এই আচরণ শুধু অখ্রীস্টানোচিতই নয়, অপরিণত এবং হঠকারিতা পূর্ণও।
- খ্যাতি পিপাসু ঐ যাজক যা করছেন, তা হিংসা প্ররোচিত করার সমান।
- উনি নিজেকে ঐ মৌলবাদী মুসলিমদের থেকেও নীচে নামাচ্ছেন।
- মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপদ আশ্রয়ে থেকে যাজক জোন্সের কোন ধারণাই নেই যে সংখ্যালঘু খ্রীস্টানরা কিভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম দেশে বাস করেন। তাঁর কোন ধারণা নেই যে তাঁর এই ছোট ঘৃণা ও প্রতিহিংসা প্রদর্শনের ফলে, কিছু নিরপরাধ মানুষের বিরুদ্ধে হিংসার সূত্রপাত হতে পারে।
- মৌলবাদী মুসলিমদের উপরে কোরান পোড়ানোর কোন প্রভাব ফেলবে না।
এই ব্লগারের সতর্কবাণী:
যদি পাদ্রী জোন্স এই উদ্যোগ বাস্তবায়িত করেন, তাহলে তাঁর নিজেকে খ্রীস্টান যাজক বলে অভিহিত করার কোন অধিকার নেই। এঁরা এমন ধরণের মানুষ, যারা নিজেদের ব্যক্তিগত এবং স্বনিয়োজিত অভিপ্রায়ের জন্য খ্রীস্টধর্ম এবং যাজকত্বকে কলঙ্কিত করেন।
পাকিস্তান:
‘চুপ!- চেঞ্জিং আপ পাকিস্তান’-এর কালসুম যাজক টেরিকে প্রশ্ন করেছেন:
আমি দুঃখিত যাজক। কিন্তু আপনি ঠিক কিসের জন্য প্রার্থনা করছেন? সামান্য সুস্থ বিচারবুদ্ধির জন্য? সহিষ্ণুতার জন্য, যা বাইবেল ও কোরান দুইয়েই প্রচারিত।
ব্লগার আরো বলেছেন:
পার্ক ৫১ “গ্রাউন্ড জিরো মসজিদ” সম্বন্ধে বিতর্কের মতোই, ফ্লোরিডার গীর্জাটি “মুসলিম দুনিয়া”কে- একটি অসার এবং কাল্পনিক শব্দ- একটি বিরাট তুলি দিয়ে রঙিন করে দেয়। আর এই সব কৃতকর্মের ফলাফল খুবই ভয়াবহ এবং কঠোর। কিন্তু এখানে উল্লেখ্য, যাজক জোন্স এবং তাঁর গীর্জাকে যত বেশী দ্ব্যর্থহীনভাবে সংবাদমাধ্যমের মনোনিবেশ দেওয়া হবে, তাদের দাম ততো বাড়বে, এবং আমেরিকায় ইসলামভীতি সম্পর্কিত বিতর্ক আরো বাড়ার সম্ভাবনা। আপাতদৃষ্টিতে এটি একটি অশেষ এবং বিপজ্জনক আবর্ত।
যদিও পাক টি হাউস-এ রাজা হাবিব রাজা মুসলিমদের অতিরিক্ত প্রতিক্রিয়া জানানোর জন্য সমালোচনা করেছেন:
আমাকে যা বিব্রত করে, তা হল আমরা সর্বদা এই ধরণের ঘটনার দ্বারা নিজেদের প্রভাবিত হতে দিয়ে থাকি। মার্কিন সরকারের সীমাবদ্ধতা পরিষ্কারভাবে জানা সত্ত্বেও কিছু শিক্ষিত মুসলমানদেরও ভুল জায়গায় ক্রোধ প্রকাশ করার প্রবণতা আছে, এবং তার চেয়েও খারাপ হল অন্যদের প্ররোচিত করা।
শ্রীলঙ্কা:
দ্য অ্যাবিস লিখেছেন:
যাঁরা এই বিশ্বব্যাপী ঘটনায় অংশগ্রহণ করছেন, তাঁদের জন্য বলছি, আপনাদের বিচারবুদ্ধি সম্পর্কে আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে। আপনাদের কি মনে হয়, একটি বই পুড়িয়ে ফেললে অতীতে ফিরে যাওয়া যাবে এবং সমস্ত প্রাণ বাঁচানো যাবে? বইগুলি না থাকলে কি আপনাদের মনে হয় যে এই ঘটনা ঘটতো না? আন্তরিকভাবে। [..]
যারা আপনাদের বিরুদ্ধে আক্রোশ দেখানোর কোন কারণ এতদিন পায়নি, তারা আপনাদের এই উদ্যোগের ফলে ক্রুদ্ধ হবে। আপনারা আগের তুলনায় অনেক বেশি সমস্যা সৃষ্টি করবেন, এবং সর্বোপরি কোরান দাহ করার মতো নির্বুদ্ধিতার মাধ্যমে। ৯/১১-র ঘটনার জন্য ধর্মকে দায়ী করা উচিত নয়। সেই ধর্মাবলম্বীদের ও নয়। দায় সেই সব ধর্মীয় চরমপন্থীদের, যারা কোরানের বাণীগুলোকে প্রসঙ্গ বহির্ভূতভাবে তুলে ধরেছে এবং আপনাদের ধ্বংস করতে উদ্যোগী নেতার বিভ্রান্তিকর নির্দেশে তারা এসব করছে। তারাই দোষী, মৌলবাদ নিজেই এর জন্য দায়ী। কোরান নয়।