ভারত: নাগাল্যান্ডে কোরিয়ার সংস্কৃতির জোয়ার

কুতুর গ্রামে ইমচুঙ্গার নাগা মেয়ে। ছবি ফ্লিকার ব্যবহারকারী রেটলো স্নেলাক এর সৌজন্যে।

কুতুর গ্রামে ইমচুঙ্গার নাগা মেয়ে। ছবি ফ্লিকার ব্যবহারকারী রেটলো স্নেলাক এর সৌজন্যে। সিসি বাই-এসএ

নাগাল্যান্ড উত্তরপূর্ব ভারতে বার্মার বর্ডার ঘেঁষা রাজ্য। নাগাল্যান্ডের জনসংখ্যা প্রায় ২০ লাখ, মূলত উপজাতি আর বেশীরভাগ খ্রিষ্টান। কিছু নাগা ভারত থেকে নিজেকে অসংযুক্ত মনে করেন- ‘জাতিগতভাবে, ঐতিহাসিকভাবে, সাংস্কৃতিকভাবে, রাজনৈতিকভাবে’, আর নাগার মানুষের ’বিশেষ বৈশিষ্ট্য’ ধরে রাখার জন্য সংগ্রাম করছেন মূল ধারার ভারতীয় প্রভাব থেকে। তারপরেও আর একটি সংস্কৃতি নাগাল্যান্ডে সম্প্রতি প্রভাব ফেলছে- সেটা কোরিয়ার।

কোরিয়ার ঢেউ’ এই বিশেষণটি বিশ্বব্যাপী কোরিয়ার সংস্কৃতির জনপ্রিয়তা তুলে ধরে, বিশেষ করে এশিয়া ব্যাপী। তবে ভারতের উত্তরপূর্ব এলাকা যেমন মণিপুরে এটি লক্ষণীয় ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। রেঞ্চানো হামসো কমিউনিটি মিডিয়া প্রচেষ্টা ইন্ডিয়াআনহার্ডে একটি ভিডিও প্রকাশ করেছেন যেখানে নাগাল্যান্ডে বাড়তে থাকা কোরিয়ার সংস্কৃতির প্রভাব নিয়ে উদ্বেগের ব্যাপারটি তুলে ধরা হয়েছে। তিনি লিখেছেন:

নাগাল্যান্ডে কোরিয়ার সংস্কৃতির বন্যা বয়ে যাচ্ছে। ভারত আর কোরিয়ার মধ্যে নতুন বাণিজ্য চুক্তি কোরিয়ার পণ্য বিনিময়ের সুযোগ তৈরি করে দেয় আর নাগাল্যান্ডে তার প্রবেশ সহজ করে দেয়। এর সাথে নাগারা দীর্ঘদিন ধরে কেন্দ্রীয় ভারতীয় সরকার দ্বারা উপেক্ষিত বোধ করেন। বিশেষ করে নাগা তরুণদের ক্ষেত্রে এটি হয়। অনেকে বিশ্বাস করেন ভারতের কেন্দ্রের সাথে পরিচিতির এই অভাব নাগাদের কোরিয়ার সংস্কৃতির দিকে আকৃষ্ট করে। [..] নাগা তরুণরা এখন বেশি পরিমাণে কোরিয়ার সংস্কৃতিকে গ্রহণ করছে। কোরিয়ার টেলিভিশন চ্যানেল, প্রোগ্রাম, চলচ্চিত্র আর পোশাক নাগার তরুণদের মধ্যে তুমুল জনপ্রিয়। কোরিয়ার কিছু কোম্পানি নাগাল্যান্ডে বিনিয়োগের সুযোগ খুঁজছে।

নাগাল্যান্ড রাজ্য সরকারও কোরিয়ার সংস্কৃতিকে আপন করার জন্য পদক্ষেপ নিয়েছে: এরা বার্ষিক ভারতীয়-কোরিয়ান সাংস্কৃতিক উৎসব পালন করে। তবে কোরিয়ার সংস্কৃতির এই জোয়ার নাগা সংস্কৃতিকেও ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। প্রথাগতভাবে নাগা সংস্কৃতি স্বতন্ত্র। নাগাল্যান্ড ১৬টা উপজাতি নিয়ে গঠিত। প্রত্যেক উপজাতির নির্দিষ্ট ভাষা আছে আর নিজেদের সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক নাচ, গান, উৎসব আর উদযাপনের অন্যান্য বিষয় আছে। তরুণ নাগাদের উপরে কোরিয়ার সংস্কৃতির শক্তিশালি প্রভাব নাগাল্যান্ডের গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহ্য আর পরিচিতি রক্ষার প্রচেষ্টা আরো কঠিন করবে।

গ্রাউন্ডরিপোর্ট এ লিখতে গিয়ে ভিডিও ভলান্টিয়ার্স (যে প্রতিষ্ঠান ইন্ডিয়াআনহার্ড প্রতিষ্ঠা করেছে) এর যোগাযোগ পরিচালক স্টেলা পল রেঞ্চানোর ভিডিও সম্পর্কে বলছেন:

এই রাজ্যের সবচেয়ে বেশী জনপ্রিয় টিভি চ্যানেল হচ্ছে কোরিয়ান আরিরাং টিভি। ডিভিডি আর সিডির দোকানগুলো কোরিয়ান ছবি দিয়ে ভর্তি, নাপিতের দোকানে জনপ্রিয় চুল কাটার ফ্যাশন হচ্ছে কোরিয়ান অভিনেতা-অভিনেত্রীদের হালের ফ্যাশন, কোরিয়ার জনপ্রিয় পোশাকগুলোর আদলে পোশাক নাগাল্যান্ডে বিক্রি হচ্ছে, এই রাজ্যের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানগুলোতে “কোরিয়ার গানের” প্রতিযোগিতা হচ্ছে, খেলার আয়োজন গুলোতে একটি নতুন বিষয় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, তা হচ্ছে “কোরিয়ান রেসলিং”।

সিকিম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞানের সহকারী প্রভাষক ওতোজিত ক্ষেত্রিমাইয়ুম, নিঙ্গোম্বাম ভিক্টোরিয়া চানুর সাথে বিশ্লেষণাত্মক একটি লেখা লিখেছেন কোরিয়ার স্যাটেলাইট চানেল, চলচ্চিত্র আর সঙ্গীতের মাধ্যমে পার্শ্ববর্তী মনিপুর শহরে কোরিয়ার জনপ্রিয় সংস্কৃতির মিশে যাওয়া নিয়ে:

অন্য দেশের কেবল টেলিভিশনের প্রোগ্রাম দেখান ভিন্ন সমাজে সংস্কৃতি বিস্তারে ভূমিকা রেখেছে। [..] কোরিয়ার স্যাটেলাইট চ্যানেল আরিরাং মণিপুরে কোরিয়ার ঢেউ এর পথিকৃত। এর জনপ্রিয়তা শুরু হয়েছে হিন্দি স্যাটেলাইট চ্যানেল নিষিদ্ধ হওয়ার পরে, যা মণিপুরবাসীর প্রিয় চ্যানেল ছিল। এরপর তারা অন্য চ্যানেল খোঁজা শুরু করে, যা তাদের পূর্ণ বিনোদন দিতে পারে।

ওতোজিত হিন্দি চ্যানেল নিষিদ্ধ হওয়া নিয়ে লিখেছেন:

মণিপুরের গোপন বিপ্লবী সংস্থা ২০০০ সালে কেবলমাত্র রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত জাতীয় টেলিভিশন চ্যানেল ডিডিটিভি ছাড়া হিন্দি চলচ্চিত্র আর হিন্দি টেলিভিশন চ্যানেলগুলো নিষিদ্ধ করে

আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল সাংস্কৃতিক নৈকট্য তত্ত্ব। এটি ধারণা দেয় যে সাংস্কৃতিকভাবে কাছাকাছি দেশের মিডিয়া প্রযোজনাগুলো সাংস্কৃতিকভাবে দুরে থাকা দেশে থেকে সহজে বেশী গৃহিত হয়। ওতোজিত অনুসারে, উত্তর ভারতের উপজাতিগুলোর অনেক সাংস্কৃতিক উপাদান কোরিয়ানদের সাথে মেলে।

কোরিয়ার বিষয় নিয়ে ব্লগ দ্যা মারমোটস হোলে রবার্ট কোহলার রেঞ্চানোর রিপোর্ট দেখেছেন আর লিখেছেন:

কোনভাবে, আমি মনে করি না [টিভি উপস্থাপক] লিসা কেলি কখনো ভেবেছিলেন কোরিয়ার সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদের চেহারা হিসাবে ইউটিউবে তার চেহারা প্রচার হবে।

তিনি যোগ করেছেন:

অবশ্যই যখন [নাগারা] তৈরি হয় পুরোপুরি কোরিয়ানদের মত হয়ে যাবে, তারা আরিরাং টিভি ছেড়ে অন্য চ্যানেল দেখবে (মার্কিন সিরিজ) এনসিআইএস আর সিএসাই:মায়ামি দেখার জন্যে।

এই পোস্ট সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে, পিভিরাই বলেছেন:

যখনি আমি মানুষকে শুনি সংস্কৃতি ‘ধরে’ রাখার কথা বলতে সংস্কৃতির লোকদের ইচ্ছাকৃত আচরণের মাধ্যমে, আমার কাছে মনে হয় সেটা বাইরের লোককে দেখাতে শান্ত গ্রামের লোকেরা যেমন সেজে গুঁজে থাকতে পছন্দ করেন তেমন। যদি এই বাচ্চারা পছন্দ না করে তাদের দাদিরা যেভাবে সেজেছিল তেমন সাজতে, সেটা প্রায় সব স্থানের বাস্তবতা। যদি আপনি আপনার সংস্কৃতি রক্ষা করতে চান, চিন্তা করেন যে কি আসলে তা তুলে ধরে আর সেটাকে আধুনিক করার পথ খুঁজে বের করেন। এর বিকল্প হচ্ছে যারা আধুনিকায়ন করে তাদের দ্বারা চাপা পড়া।

আর একজন মন্তব্যকারী, এবিসিডিইএফজি, দেখেছেন কোরিয়ার সংস্কৃতি কেন জনপ্রিয়:

কোরিয়া পপ সংস্কৃতির বিবিমপপ এর মতো। এখানে কিছুটা জাপানি, কিছুটা আমেরিকান, কিছুটা শহুরে জিনিষ, কিছুটা ৯০ এর দশকের র‍্যাপ, কিছুটা কোরিয়ার মশলা এখানে, কিছুটা পূর্ব এশিয়ার বস্তু ওখানে এভাবে গুলিয়ে দিন। কোরিয়ার পপ সঙ্গীত অনেকগুলো জেনেটিক সংমিশ্রণে তৈরি, আর এই পর্যায়ে এডমিক্সচারের মত এটা নিজের পরিচিতি পেয়েছে; এর বিষয়গুলো স্বতন্ত্র না কিন্তু সব মিলিয়ে এর নিজের আলাদা স্বাদ আছে।

কোরিয়ান কেপপ সংস্কৃতি অন্যান্য এশিয়ানদের আকর্ষণ করে কেন? কারণ এটা সহজ সাধারণ। যেসব সামাজিক মূল্যবোধ কেপপ বের করে তা বস্তুবাদী, অগভীর আর যৌনতা বিষয়ক। যখন কোন পণ্য এমন সব জিনিষ নিয়ে তৈরি, সেটা পরিপূর্ণ হয়ে থাকে। আর বলা যায় যে কেপপ জনপ্রিয় কারণ এটা আধুনিক আমেরিকান সংস্কৃতির সাথে সব থেকে বেশী খাপ খায় আর এই কারনে এটা তাদের সাথে মেলে যারা আমেরিকা আর হলিউড সংস্কৃতি দেখে অভ্যস্ত।

তাহলে নাগা সংস্কৃতিতে কোরিয়ার প্রভাব নিয়ে চিন্তার কিছু কি আছে? এই ধরনের প্রভাব কি ‘বিশ্বায়নের’ অংশ? নাকি এটা ক্ষণিক কোন বিষয় যা সময়ের সাথে ঠিক হয়ে যাবে? আপনি কি মনে করেন?

আলোচনা শুরু করুন

লেখকেরা, অনুগ্রহ করে লগ ইন »

নীতিমালা

  • অনুগ্রহ করে অপরের মন্তব্যকে শ্রদ্ধা করুন. যেসব মন্তব্যে গালাগালি, ঘৃণা, অবিবেচনা প্রসূত ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকবে সেগুলো প্রকাশের অনুমতি দেয়া হবে না .