কখনো চিন্তা করেছেন আপনার টি শার্ট বা প্যান্ট কোথায় তৈরি হয়? যদি আপনি উত্তর আমেরিকা বা পশ্চিম ইউরোপে বাস করেন, তা হলে খু্ব সম্ভাবনা রয়েছে যে আপনি বাংলাদেশের তৈরি একটি পোশাক পরে আছেন। এতে কোন বিস্ময়ের কিছু নেই যে বাংলাদেশ তৈরি পোশাক রপ্তানি থেকে সর্বোচ্চ পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে, যা দেশটির মোট রপ্তানি আয়ের শতকরা ৭৫ শতাংশ।
তবে সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কিছুদিন ধরে পোশাক শিল্পে শ্রমিক ও মালিকদের মধ্যে বেতন সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে এক দ্বন্দ্ব শুরু হয়েছে। পোশাক শিল্পের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সুবিধা হচ্ছে দক্ষ শ্রমিক আর স্বল্প মজুরি, কিন্তু মুদ্রাস্ফীতির কারণে পুরোনো সামান্য বেতনে জীবন চালান এখন অসম্ভব প্রায়। পোশাক শিল্পের মালিকরা লম্বা সময় ধরে ন্যূনতম বেতন কাঠামোর দাবি এই বলে ঠেকিয়ে রাখতে সমর্থ হয় যে বেতন বেড়ে গেলে তারা প্রতিযোগিতামূলক বাজারে টিকে থাকতে পারবে না এবং বিশেষ করে বিশ্বে বিরাজমান অর্থনৈতিক মন্দার পরিস্থিতিতে তারা বাজার হারাবে। তাদের দর কষাকষির জায়গা, বেশিরভাগ শ্রমিকের ওভারটাইম বা নির্ধারিত সময়ের পরে কাজ করাকে নিয়ে, মালিকদের মতে এর ফলে শ্রমিকরা ন্যূনতম বেতনের চেয়ে দেড় থেকে দ্বিগুন বেশি অর্থ উপার্জন করে। কিন্তু এই বিষয়টি অস্বাস্থ্যকর ভাবে শ্রমিকদের শ্রম শোষণের মত ঘটনার পরিমাণ বাড়িয়ে দিয়েছে।
সারা দেশের প্রায় ৫০০০ গার্মেন্টসে প্রায় ৩০ লক্ষ শ্রমিক কাজ করে এবং তাদের শতকরা প্রায় ৮০ ভাগই নারী। মাহফুজুর রহমান মানিক এবারকার ন্যূনতম বেতন কাঠামোর বিষয়ের পেছনের ঘটনাটি জানাচ্ছে:
সর্বশেষ ২০০৬ সালে বর্তমান বেতন কাঠামো নির্ধারণ করা হয়। সর্বনিম্ন বেতন স্কেলের জন্য তখন মজুরি বোর্ডের সুপারিশ ২৩০০ টাকা থাকলেও মালিক পক্ষের চাপাচাপিতে নির্ধারণ করা হয় ১৬৬২ টাকা। বর্তমান মূল্য ও মুদ্রা; দুইয়ের স্ফীতির এই বাজারে একজন শ্রমিকের নিজের পক্ষেই শহরতলীর বস্তিতেও দিনযাপন করা অসম্ভব। তিন বছর পার হলেও সে বেতনের আর পরিবর্তন হয় নাই।
মোহাম্মদ গোলাম নবী বেতন বৃদ্ধির পক্ষে কথা বলেছেন:
বেতন বৃদ্ধির দাবীতে গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিগুলোর উত্তাল হয়ে উঠার বিষয়টি বেশি করে শুরু হয়েছে ২০০৭ সালের শেষ ভাগে। [..]
আমাদের গার্মেন্টস শ্রমিকদের একদিনের বেতন ৫৫ টাকা থেকে শুরু। এই টাকায় খাবে, ঘর ভাড়া দেবে, সাবান কিনবে, গোসল করবে আমরা কি করে আশা করি। [..] প্রজনন স্বাস্থ্যের যত্নবিহীন এই নারীরা যে সন্তান জন্ম দেবে, সেই সন্তান এই দেশের আগামী প্রজন্ম মনে রাখুন।
শরিফ কাফি লিখেছেন যে বর্তমানে গার্মেন্টস শিল্পে যে অস্থিরতা তা শুধু বেতন বৃদ্ধির কারণে নয়, কতিপয় মালিকের শোষণের কারণেই এই অস্থিরতা:
এসব ঘটনা ঘটার মূল কারণ শ্রমিকদের অত্যন্ত কম বেতন দেয়া, গার্মেন্টস মালিক কর্তৃক বেতন বকেয়া রেখে পরে তা শোধ না করা, বকেয়া বেতন ও বকেয়া ওভার টাইম এবং বকেয়া ভাতাদি পরিশোধ না করে হঠাৎ করে ফ্যাক্টরি বন্ধ করে দেয়া এবং ঈদের আগে সময় মত বেতন-বোনাসের টাকা পরিশোধ না করা অথবা না করে ফ্যাক্টরী বন্ধ করে দেয়া। অথচ এক শ্রেনীর গার্মেন্টস মালিকরা এসব ঘটনাকে বিদেশী চক্রান্ত বলে সবার চোখে ধুলো দেয়ার চেষ্টা করছে।
মালিক ও শ্রমিকদের লম্বা সময় ধরে চলা দরকষাকষির পর, সরকার অবশেষে সিদ্ধান্ত নিয়েছে শ্রমিকদের বেতন বাড়িয়ে প্রতিমাসে ন্যূনতম ৩০০০ টাকা নির্ধারণ করা হবে (৪৪ ডলার প্রায়), যা বর্তমান বেতনের প্রায় দ্বিগুণ। ন্যূনতম বেতন কাঠামোর ঘোষণা আগামীকাল (২৯শে জুলাই, ২০১০) আনুষ্ঠানিকভাবে করা হবে।
ব্লগার, লেখক এবং শিল্পেদ্যোক্তা আরিফ জেবতিক বেতন কাঠামো নিয়ে বেশ কিছু প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন গার্মেন্টস শিল্পের ব্যবস্থাপকদের পরিপ্রক্ষিতে। সচলায়তনেলেখা তার পোস্টের কিছু অংশ তুলে ধরা হল:
* নতুন বেতন যদি নূন্যতম বেতন ৩০০০ টাকা করা হয়, তাহলে এই সেক্টরে কী সমস্যা দেখা দিতে পারে ? গার্মেন্ট শিল্প কি বন্ধ হয়ে যাবে ?
: নাহ, আদতে তেমন কোনো ক্ষতি হবে না। কারন তখন সব গার্মেন্টসই বেতন বাড়াতে বাধ্য হবে, সুতরাং তারা মূল্যও বেশি দাবি করবে। বায়ারদের হাতে এই মুহূর্তে কোনো বিকল্প নেই, তাই তারা বেশি দামেই কাপড় কিনতে বাধ্য হবে। মনে রাখতে হবে আমরা যে কাপড় সেলাই করি, সেটি খুবই বেসিক এবং কম দামের, সুতরাং এই কাপড়ের চাহিদা দুনিয়াতে থাকবেই।
* নতুন বেতন বৃদ্ধিতে গার্মেন্টের লাভ কমে যাবে বলে অনেকেই ধারণা করছেন। গার্মেন্ট শিল্পগুলো কিভাবে চলবে তখন ?
: আসলে বেতন বৃদ্ধি আমাদের জন্য এক ধরনের আশীর্বাদ হিসেবে আসবে বলে আমার ধারণা। এখন গার্মেন্টসগুলো বাধ্য হবে নতুন প্রযুক্তির প্রচলন করতে এবং বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে উৎপাদন ব্যবস্থাপনা করতে। এটি এই শিল্পের জন্য ভালো হবে। প্রোডাকশন ইঞ্জিনিয়ারিং চালু হবে, দক্ষ শ্রমিক ও মিড লেভেল ব্যবস্থাপনা তৈরীর জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।