ফেসবুকের নতুন একটা অ্যাপ্লিকেশন ভারতে বির্তকের সৃষ্টি করছে। ফেসবুকের এই অ্যাপের নির্মাতা হচ্ছে ভ্যাসেলিন, যা ইউনিলিভারের মালিকানাধীন একটি ক্রীম জাতীয় পণ্য। এই অ্যাপটি ফেসবুকের ব্যবহারকারীদের প্রোফাইলের ছবিতে চামড়ার রঙ ফর্সা করার সুযোগ দিচ্ছে। এটি প্রথমবার না যে ‘ফর্সা’ হওয়ার পণ্য নিয়ে ভারতীয় ব্লগ জগৎে বহুল আলোচিত হয়েছে। তবে যে অ্যাপ্লিকেশনটির কথা বলা হচ্ছে সেটা পুরুষদের ফর্সা করার পণ্য তুলে ধরছে, যেটা একটা নতুন ধারা। এখন পর্যন্ত গায়ের রং ফর্সা করার পণ্য ভারতে নারী ভোক্তাদের লক্ষ্য করেই সাধারণত: বাজারজাত করা হয়। লে সাই লক্ষ্য করেছে:
এই বিজ্ঞাপনের যে ব্যাপারটা আমার চোখে সব থেকে বেশী লাগে সেটা হল, এটা পুরুষদের ফর্সা ত্বকের প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরে কেবলমাত্র মেয়েদের না। এটার জন্য আমার মাথায় গন্ডগোল হয়ে যায় কারন এই অঞ্চলে বলতে গেলে মহিলারা এই ধরণের সংস্কৃতি তুলে ধরেন, পুরুষরা না। এক দিক থেকে এইসব বিজ্ঞাপন অগ্রগতির লক্ষণ কারন ‘ফর্সা’ হওয়ার ব্যাপারে তারা পুরুষদের চাহিদাও অন্তর্ভুক্ত করেছে।
লে সাই এর পোস্টের উত্তরে, মন্তব্য করেছেন স্নেহা, যিনি একটা বিজ্ঞাপন সংস্থাতে কাজ করেন, আর সেখানে তিনি কিছু কারন তুলে ধরেছেন কেন প্রস্তুতকারকেরা পুরুষদের রং ফর্সা করার ক্রিমের প্রতি জোর দিচ্ছে।
ভারতের শহুরে পুরুষরা আগের থেকে এখন অনেক বেশী সচেতন তাদের বাহ্যিক সৌন্দর্যের ব্যাপারে। আজকে, কর্মক্ষেত্রে বা অন্য কোথাও, অনেক বেশী পুরুষ নারীদের সংস্পর্শে আসছেন যারা তাদের আয় আর কাজের মানের সমকক্ষ। আর আয়োজিত বিয়ে ব্যবস্থার চল বাদ দিয়ে বিয়ের আগে মেলামেশা যখন সাধারণ ব্যাপারে পরিণত হচ্ছে, পুরুষদের উপরে চাপ বৃদ্ধি পাচ্ছে সুন্দর ভাবে নারীদের সামনে নিজেদেরকে উপস্থাপনা করার ব্যাপারে… ভারতীয় সংস্কৃতিতে ফর্সা হওয়া যুগ যুগান্তরের আকাঙ্ক্ষা – পুরুষদের সাথে দলগত আলোচনা আর সাক্ষাতকারের সময়ে আমরা এটা দেখতে পাই। আর যখন জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল কোন একটি জিনিষ তারা পরিবর্তন করতে চান – এটা অবশ্যই তাদের চামড়ার রঙ।
র্যান্টিংস অফ আ হোমসিক লুনাটিক ব্লগের সুহেইল ভারতে যে সুক্ষ্ণ বর্ণবাদী দিকটার অস্তিত্ব আছে সেটা আলোচনা করেছেন, যেখানে অনেক সমাজে ফর্সা চামড়াকে বেশী পছন্দ করা মানুষের মনের ভিতরে প্রোথিত। এই লুকানো পছন্দ অনেকভাবে উন্মোচিত হতে পারে।
বেশ পরিষ্কার কিছু ব্যাপার দেখা যায় চলচিত্র জগৎে – দক্ষিণে নারীদের দুধের মতো সাদা ত্বক লাগে তারকাদের সাথে অভিনয়ের সুযোগ পাওয়ার জন্য, যারা মাঝে মাঝে খুবই ফর্সা হয়ে থাকেন কিন্তু সেটা বেশী নারীবিদ্বেষী বর্ণবাদ থেকে। আমার কাছে এটা প্রায় পরিষ্কার যে টিভি আর মিডিয়ার লোকেরা ক্যামেরার সামনে উপস্থাপনের জন্য সব সময়ে ফর্সাদের দিকে বেশী ঝুঁকে পড়ে।
ফ্রেশব্রিউ বলেছে যে পণ্যের বাজারজাত করার কৌশলকে ঘিরে এই আলোচনা হচ্ছে তা এটা শুধুমাত্র ‘রং ফর্সা’ করার ব্যাপারটি বাজারজাত করতে চাচ্ছে সেটি কেন্দ্র করে নয় বরং এটি বিক্রি করতে চাচ্ছে পুরুষদের কাছে, সে কারনেই মানুষ উঠে বসে এর প্রতি নজর দিচ্ছে। ভ্যাটন্যাচারালি জানিয়েছে যে এই পণ্যের উৎপাদনকারীদের দোষ দেয়ার কোন মানে হয়না, আর এই প্রচারণার ‘ডিজিটাল’ ব্যাপারটা এই পণ্য আর অ্যাপ্লিকেশনের দিকে বেশী দৃষ্টি আকর্ষণ করছে।
মানুষ এই ধরনের ব্র্যান্ডকে দোষারোপ করেন ফর্সা হওয়ার ব্যাপারটিকে উত্তম আর বেশী চাহিদার জিনিষ হিসাবে দেখানোর জন্য আর এর ফলে সমাজের ক্ষতি হয়। এর বিরুদ্ধে বিতর্ক হচ্ছে যে এই ধরণের ব্র্যান্ড কেবলমাত্র পূর্বে থেকে থাকা চাহিদাকে কাজে লাগাচ্ছে (এমন ধরনের পণ্য তৈরীর চিন্তা বা প্রচারের অনেক আগে থেকেই) যা কেউ শুনছেন না।
বিভিন্ন ব্লগে বিভিন্ন মন্তব্যে এমনই মনোভাব শোনা যাচ্ছে, যেখানে অনেকে মনে করছেন যে ফর্সাদের প্রতি মানুষের পছন্দ যারা বিচার করছেন তারা বিদ্যমান সংস্কৃতিক পরিস্থিতির সাথে পরিচিত নন আর তাই বর্ণবাদের কথা আসছে। গৌতম রামদুরাই ডেনাহ বয়েডের পোস্টে মন্তব্য করেছেন:
পশ্চিমের এই নিয়ে হইচই করা বেশ মজার- আর কিছুটা অজ্ঞতার কারনে হচ্ছে। ব্যাপারটা হচ্ছে সৌন্দর্য নিয়ে মানুষ কি ভাবে সেটা নিয়ে, বর্ণবাদের ব্যাপার না। যারা এই ব্যাপারে মন্তব্য করছেন তাদের অনেকেই জানেন না ভারতে সৌন্দর্যের সংজ্ঞা কি- আর তাই এটাকে ‘বর্ণবাদী’ বিষয় হিসাবে দেখা হচ্ছে। ভারতে এমন মানুষ আছে যারা মনে করে এই অ্যপ্লিকেশন (আর এই পণ্য) ঘৃণ্য- কিন্তু অন্য কারনে। আমি একই অভিযোগ অনেক পশ্চিমা পণ্যের বিরুদ্ধে করতে পারি- যেমন ট্যানিং সালোন, রোগা থাকার প্রচন্ড ইচ্ছা ইত্যাদি- কিন্তু এটার কোনটাই এই ব্যাপারের জটিলতা বোঝানোর জন্য যথেষ্ট না। আমার অবাক লাগে যে, কি করে ‘চ্যাপ্টা বিশ্বের’ অংশ হিসাবে- আমরা এখনো আমাদের পক্ষপাতিত্বের চশমা না খুলে দেখি বিচার করি বিশ্বের অন্য দিকের সামাজিক-সাংস্কৃতিক ঘটনা।