২৩ নভেম্বর,২০০৯-এ বর্তমান রাষ্ট্রপতি মাহিন্দা রাজাপাক্ষে ঘোষণা দেন যে শ্রীলন্কার পরবর্তী রাষ্ট্রপতি নির্বাচন ২৬ জানুয়ারি, ২০১০-এ অনুষ্ঠিত হবে। বিশ্লেষকদের মতে রাষ্ট্রপতি হিসেবে ২০১১ সালে তার প্রথম দফা মেয়াদ শেষ হবার আগেই তিনি এক নতুন নির্বাচন চান। কারণ তিনি ২০০৯ সালে তামিল টাইগারদের পরাজিত করে বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন। সময় থাকতে নির্বাচন দিয়ে তিনি তার এই জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগাতে চান। রাজাপাক্ষের এই জনপ্রিয়তাকে প্রতিহত করার জন্য শ্রীলন্কার প্রধান বিরোধী দল (ইউএনপি) একটি সম্মিলিত জোট গঠন করেছে। এই জোটের লক্ষ্য, এক হয়ে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করা এবং সেই পদে তাদের মনোনীত প্রার্থী হয়েছেন প্রাক্তন সামরিক বাহিনীর প্রধান জেনারেল শরত ফনসেকা। টাইগার অফ তামিল ইলম (এলটিটিই) বাহিনী এবং সশস্ত্র তামিল আন্দোলনকে পুরোপুরি পরাজিত করার পেছনে তার পরিকল্পনা প্রধান চালিকা শক্তি ছিল। যদিও নির্বাচনে রাষ্ট্রপতি পদে ২৩ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বীতা করছে, তবে মাহিন্দা রাজাপাক্ষে ও শরত ফনসেকার মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে নির্বাচনের মূল মনোযোগের বিষয়।
নির্বাচনের দিন যত ঘনিয়ে আসছে, ততই প্রচারণা তীব্র হচ্ছে এবং তার উত্তাপ শ্রীলন্কার ব্লগ জগৎে টের পাওয়া যাচ্ছে। অনেক ব্লগার তাদের প্রার্থীর সমর্থনে লিখছেন এবং তারা যুক্তি এবং প্রতিপক্ষের যুক্তির পাল্টা যুক্তি প্রদান ও বিশ্লেষণ করে শক্তিশালী বিতর্কে লিপ্ত হচ্ছে।
মাওবিমা শ্রীলন্কা মাহিন্দা রাজাপাক্ষের মেনিফোস্টো বা প্রচারপত্র সম্বন্ধে লিখেছেন:
রাষ্ট্রপতি মাহিন্দা রাজাপাক্ষে ১৪টি বিষয় যুক্ত করে এক অনুষ্ঠানসূচির কথা উল্লেখ করেন। এর শিরোনাম, ‘উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ’। এই প্রচারপত্রে প্রতিশ্রুতি প্রদান করা হয়েছে যে, এশিয়া ও বিশ্বের মাঝে শ্রীলন্কাকে এক সম্ভাবনাময় জায়গায় নিয়ে যাওয়া হবে, এর মধ্যে থাকবে জাতিগত দ্বন্দ্বের এক রাজনৈতিক সমাধান।
গ্রাউন্ডভিউজ চেষ্টা করেছেন শরত ফনসেকার মেনিফিস্টো বা প্রচারপত্রের বিস্তারিত প্রতিশ্রুতিকে দেখার, যেখানে তিনি একসাথে ভোটারদের সামনের দিকে তাকানোর এবং সুন্দর ভবিষ্যৎ নির্মাণের আহ্বান জানিয়েছেন। গ্রাউন্ডভিউজের কুশল পেরেরা, শরত ফনসেকার প্রচারপত্র বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করেছেন:
এখানে তামিল জনগণের জন্য কোন প্রতিশ্রুতি নেই। জেনারেল (অবসরপ্রাপ্ত) ফনসেকার প্রচারপত্র কেবল দক্ষিণের সিংহলীদের জন্য, প্রচারপত্রে তাদের প্রতি দেওয়া প্রতিশ্রুতিতে ভরে রয়েছে ।[…]
এভাবে আমাদের এক বিকল্প প্রার্থীর কাছ থেকে ভিন্ন কিছু পাবার প্রত্যাশা খতম হয়ে গেল, যাকে রাজনৈতিক দলগুলো সমর্থন দিয়েছে। তার কাছে নেই কোন উন্নয়ন পরিকল্পনা, নেই গণতন্ত্রের জন্য পরিকল্পনা এবং পুনর্গঠনের জন্য কোন কর্ম সূচি এবং এছাড়াও যথারীতি দুর্নীতি থামানোর কোন পরিকল্পনা তার নেই। উভয় প্রার্থীর কাছে এসব বিষয়ে কোন পরিকল্পনা নেই। দু'টি দলের কাছেই কিছু নেই, যে দল সরকারে আছে এবং যারা বিরোধী দলে আসীন।
এর ফলে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে আমাদের কোন বিকল্প পছন্দ থাকল না, যাকে আমরা বেছে নিতে পারি এবং জানতে চাই না যে, আমরা একই ধরনের ভজঘট পাকানো ব্যক্তিদের ভোট দিতে যাচ্ছি। হয়তো এদের মধ্যে কেউ একজন সুন্দর পোশাকে ভালো জিনিস উপহার দিবে, কিন্তু অন্যদের বিশ্বাস করাতে চাই না যে, এটা কোন পরিবর্তন বয়ে আনবে।
আমরা ব্লগারদের কাছ থেকে কিছু উত্তেজিত প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করেছি। লংকা রাইজিং দৃঢ়তার সাথে বলছেন যে শরত ফনসেকার নির্বাচনী মেনিফিস্টো বা প্রচারণা একগাদা ‘মিথ্যা’ ছাড়া আর কিছুই নয়। অন্যদিকে বলা যায়, লংকা পলিটি মাহিন্দা রাজাপাক্ষের বিপক্ষে তীব্রভাবে প্রচারণায় জনতার সম্পত্তি এবং কর দাতাদের টাকার অপব্যবহারের অভিযোগ এনেছেন। শ্রীলন্কার নেটওয়ার্কের মধ্যে থাকা সকল মোবাইল ফোনের গ্রাহকের কাছে অবৈধ এসএমএস বা সংক্ষিপ্ত বার্তা পাঠানোর জন্য রাজাপাক্ষে সমালোচিত হয়েছেন। গ্রান্ডভিউজের সানাজানা হাটটোটুওয়া আন্তর্জাতিক প্রচার মাধ্যমের ওয়েব সাইটে মাহিন্দার বিজ্ঞাপনী প্রচারণা নিয়ে প্রশ্ন করেছেন এবং রাষ্ট্রপতির কাছে এক খোলা চিঠি পাঠিয়েছেন, যেখানে তিনি প্রশ্ন করেছেন:
কেন আপনার আনুষ্ঠানিক ওয়েব সাইট প্রচারণা সংক্রান্ত খরচের ব্যাপারে কোন তথ্য নেই? একজন ভোট দাতা হিসেবে আমি কি ভাবে নিশ্চিত হব যে, আপনি বিলাসিতায় এবং পুনরায় নির্বাচনী প্রচারণায় যে খরচ করছেন, তা জনতার টাকা নয়?
গোয়িং গ্লোবাল এই প্রচারণার সারাংশে প্রতি নজর দিয়েছেন:
আত্মপ্রচারণা সাধারণত এখানে অবৈধ এবং বেশিরভাগ অর্থ প্রদান করা হয় দ্বৈত মানে সৃষ্টি করে। মাহিন্দার ক্ষেত্রে বলা যায়, তিনি এই শব্দটিকে নিয়ন্ত্রণ করছেন। তিনি রাষ্ট্রকে নিয়ন্ত্রণ করেন এবং যুক্তি দিয়ে বলা যায়, আইনকে তিনি নিয়ন্ত্রণ করেন। তিনি এমন এক খেলার নিয়ম তৈরি করেছেন, যাতে ফনসেকা খেলার উপযুক্ত সামগ্রী পাবে না। যখন বিষয়টি প্রচারণার ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয়, তখন তা জঙ্গলের নিয়মে পরিণত হয়ে দাঁড়ায় এবং যোগ্যরাই টিকে থাকে এই প্রবাদটি সামনে চলে আসে। যখন খেলার শর্ত নির্ধারণ করা হয়, তখন এটা কোন বিস্ময়ের বিষয় বলে মনে হয় না যে, যার ক্ষমতা বেশি তিনি খেলায় বেশি সুবিধা নেন।
শ্রীলন্কার উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক ব্লগার লেফ্রয় বলেন:
প্রশ্ন করা যেতে পারে, কার নির্বাচনী প্রচারণা উত্তম? হুমম. বলা কঠিন। মাহিন্দা এই ক্ষেত্রে সামান্য এগিয়ে রয়েছে। কিন্তু শরত অনেক কম অর্থ ব্যয় করে, অনেক ভাল করছেন এবং তিনি এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের ক্ষমতা ব্যবহার করছেন না।
গ্রান্ডভিউজের ডায়াপালা থিরানাগামা আলোচনা করছেন প্রচারণায় কোন প্রার্থী এগিয়ে রয়েছে:
মনে হচ্ছে নির্বাচন রাজনৈতিক শক্তিকে নতুন করে আকার দিচ্ছে, যা যুদ্ধের পূর্বে তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছিল। একই সাথে তা এই শক্তির মাঝে পুরোনো সমস্যাকে আবার সামনে নিয়ে আসছে। এই নির্বাচন শ্রীলন্কাকে একটি বাঁকের মুখে এনে দাঁড় করিয়েছে। এটা আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি এক ধরনের অভিযোগ, যারা টাইগারদের পরাজয়ের পর শান্তির বারতা বয়ে আনার সুযোগ লাভ করেছে। এই সকল কিছু ভোটারদের বেছে নেবার সুযোগ প্রদান করে, দু'টি দলের মধ্যে একটিকে, যার একটির রয়েছে গণতন্ত্র বিরোধী ইতিহাস এবং তার প্রতিদ্বন্দ্বী দলের রয়েছে দমনমূলক চরিত্র। একবারে বলা যায়, এটি আমাদের ক্ষণভঙ্গুর গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ ছাড়া আর কিছুই প্রদান করে না।
লংকা পলিটি বলছেন যে, এই নির্বাচনে তামিলরা এক দ্বৈততার মধ্যে রয়েছে। দুজন প্রার্থীর মধ্যে যে কম খারাপ তারা তাকে বেছে নিতে বাধ্য হবে।
দা এ্যাবিস আত্মবিশ্বাসের সাথে বলছেন যে, বিরাজমান অবস্থার কথা বিবেচনা না করা, ভোটের ক্ষেত্রে একটি বিষয় হয়ে দাঁড়াতে পারে:
যদি উভয় প্রার্থী নীচু মানের হয়, তার মানে এই নয় যে, তাদের মধ্যে থেকে কাউকে বেছে নেওয়া ভুল সিদ্ধান্ত হতে পারে। বিবেচনা না করেই আপনি কাজটি করেন বা করেন না, কিন্তু আপনি ভিন্নতার সৃষ্টি করতে পারেন। আপনি যা জানেন, এটি তারচেয়ে বেশি। আপনি কোন প্রতিক্রিয়া প্রদান না করেই, প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করছেন। কাউকে বেছে না নিয়ে, আপনি এক পছন্দ তৈরি করছেন। ভোট প্রদান না করে, আপনি কাউকে ভোট প্রদান করছেন।
গ্রাউন্ড ভিউজের জেড ফারনান্ডো এই নির্বাচনে কিছু আশার বিষয় দেখছেন:
ফনসেকা জিতুক বা না জিতুক, যদি আমরা নির্বাচনে তার ভোট বৃদ্ধির জন্য কাজ করি, তা হলে আমরা ভবিষ্যৎ-এ এক শক্তিশালী বিরোধী দল পাব এবং সফলভাবে গণতন্ত্রের জন্য জায়গা তৈরি করতে পারব। এর মধ্যে দিয়ে আমরা একদিন শাসকদলকে আরো জবাবদিহিতামূলক করতে পারব। এটি করার মধ্যে দিয়ে আমরা শাসক দলকে পরবর্তী নির্বাচন আরো নিরপেক্ষ এবং সুষ্ঠু করার জন্য চাপ দিতে করতে পারব। এভাবে আমরা এই নির্বাচনের প্রতি আমাদের মনোভাব প্রদান করতে পারি। বিরোধী দলকে ঠিকমতো গড়ার ক্ষেত্রে কাজ না করলে, এমনকি কম পছন্দের প্রার্থী নির্বাচিত করার মধ্য দিয়েও আমরা নৈরাজ্যবাদ এবং হতাশার কর্দমাক্ত পথ এড়াতে পারব।