২৯ নভেম্বর রোববার, ৫৭.৫ শতাংশ সুইস ভোটার নতুন মসজিদের উপর মিনার নির্মাণে নিষেধাজ্ঞা জারির উপর অনুমোদন প্রদান করেছে [1]। এর ফলে দেশটির সংবিধান সংশোধন করা সম্ভব হবে। এই সংশোধন কেবল নতুন করে তৈরি মিনার তৈরির উপর প্রয়োগ হবে, কোন নতুন মসজিদ তৈরির উপর নয়। এবং এই নিষেধাজ্ঞা সুইটজারল্যান্ডে বর্তমানে যে চারটি মিনার রয়েছে তার উপর প্রযোজ্য হবে না।
এই নিষেধাজ্ঞা আরব ও মুসলিম ব্লগ জগৎে এক মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে: যেখানে কিছু ব্লগার এই নিষেধাজ্ঞার তীব্র নিন্দা করেছে, সেখানে অন্য ব্লগাররা যুক্তি প্রদান করছে মিনারের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করার মানে এই নয় যে, ধর্মীয় প্রার্থনাকে বিরত রাখা হচ্ছে।
লেবানীজ -আমেরিকান পিয়ের ট্রিসট্রাম এবাউট.কমে ব্লগ করেন। তিনি তার একটি পোস্ট শুরু করেছেন [2] নিচের কটি লাইন দিয়ে। এই অনুচ্ছেদে তিনি সুইটজারল্যান্ডের এই সিদ্ধান্তের নিন্দা করেছেন:
২০০৪ সালে জর্জ ডাব্লিউ বুশ পুনরায় আমেরিকার রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হবার পরের দিন ব্রিটেনের ডেইল মেল একটি বিখ্যাত প্রশ্ন [3] করেছিল, সেটি হল: কি ভাবে পাঁচ কোটি ৯০ লক্ষ লোক এক সঙ্গে এতটা নির্বোধ হতে পারে। ডেইলি মেইল তার লজ্জা দেয়া পাতায় আবার লিখতে পারে: কি ভাবে সুইটজারল্যান্ডের ৩০ লক্ষ লোক এতটা মাথামোটা হতে পারে?
ট্রিসট্রাম এই কঠোর মন্তব্যের মধ্যে দিয়ে তার রচনা শেষ করেছেন: “ইরানের চরম বর্ণবাদী [4] রাষ্ট্রপতি মাহমুদ আহমাদিনেজাদ [5] ও গড়ে একজন সুইস নাগরিকের মধ্যে যে পার্থক্য ছিল, তা কমে আসল”।
মিশরীয় ব্লগার হিশাম মাগেদ তার পোস্টে এই বিষয়ে একটা উত্তর সন্ধান করছে এবং তিনি উপসংহার টেনেছেন [6] এভাবে:
সংক্ষেপে বলা যায়, আমি সুইস নাগরিকদের দিকে তাকিয়ে আছি যেন তারা পুরো বিষয়টিকে পুনরায় মূল্যায়ন করে; এটা কেবল আইনের আশ্রয়ে থাকা নাগরিক অধিকার বা সে রকম কিছু নয়, এটা তার চেয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ এক বিতর্কের বিষয় এবং যা সঠিক রায়ের জন্য সুইটজারল্যান্ডের আদালতে যাবে বলে আমি নিশ্চিত। কিন্তু আমার কাছে তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এই ভয়াবহ ভুলকে একটা সতর্ক সঙ্কেত হিসেবে দেখা, যেখানে অজ্ঞতার পঙ্কে পতিত না হওয়া, কেবল ভয়, রাগ এবং নির্বুদ্ধিতা ছাড়া আর কিছুই নেই- সব খানে!
অন্য আরেকজন মিশরীয় ব্লগাররের ব্লগ শিরোনাম নট গ্রীন ডাটা বা সবুজ তথ্য নয়। তিনি এই মতবাদকে চিহ্নিত করেছেন এভাবে যে “একটি মসজিদ অবশ্যই একটি মসজিদ”, কিন্তু তিনি বেদনার্ত [7] কারণ সু্ইসদের এই নিষেধাজ্ঞার কারণে মসজিদের সৌন্দর্য হারিয়ে যাবে:
আপনি সুইটজারল্যান্ডের পনির তার চোখ বা ছিদ্র ছাড়া কল্পনা করতে পারেন- তার ভেতরে যে ছিদ্র, যেটা তার চোখ? কিংবা চৌম্বক অথবা স্ক্রু ড্রাইভার ছাড়া সুইটজারল্যান্ডের গর্ব সুইস চাকু? সুইটজারল্যান্ডের লোকেরা মসজিদের ক্ষেত্রে ঠিক এ রকম কিছু করতে চাচ্ছে। মিনার ছাড়াই একটি মসজিদ মসজিদই থাকবে এবং সেটা ছাড়াই তার যা কাজ তা সে পালন করতে থাকবে, কিন্তু সেক্ষেত্রে সে তার স্থাপত্য এবং সৌন্দর্য পরিচয় হারিয়ে ফেলবে।
ব্রিটিশ ব্লগার ম্যাথু টেলার, মধ্যপ্রাচ্য ভ্রমণ বিষয়ক লেখক। তিনি বিভিন্ন সুইস পোস্টারে এই বিষয়ে যে প্রচারণা চালানো হয়েছে তার উপর মনোযোগ প্রদান করেছেন।
এই পোস্টে উভয় পক্ষের প্রচারণা তুলে ধরেছে। এখানে বাম দিক থেকে পোস্টারের বর্ণনা [8] প্রদান করা হচ্ছে:বিরক্তিকর সুইস পিপলস পার্টি বা এসভিপি [9], বিষয়টিকে বাজে ভাবে ব্যবহার করেছে। ফিনানসিয়াল টাইমসের ভাষায় এটি “স্ট্রিডেন্ট পপুলিজম [10]” বা তীব্র এক রাজনৈতিক দর্শনের বিষয় জনপ্রিয়তা অর্জনের জন্য বিদেশীদের শিকার করা। সুইটজারল্যান্ডে সকল বিদেশী অপরাধী, ধোঁকা দিয়ে সুবিধা নেয় অথবা তার চেয়ে খারাপ, ঠিক বিপরীত একটা পোস্ট দিয়ে এই প্রচারণা শুরু হয়েছে: থাম! মিনার নির্মাণের উপর নিষেধাজ্ঞা পর্যন্ত ঠিক আছে”। এরপর এইসব ছবির দিতে তাকান: মিনার মিসাইলের মত; মেয়েরা যেন ক্ষতিকর, বোরখা যেন লুকানোর স্থান, কালোরা যেন হুমকি প্রদান করার উপাদান, সুইটজারল্যান্ডের পতাকায় পূবের ছায়া যেন ঘিরে ধরছে, পতাকার আড়াআড়ি রেখা মুছে যাচ্ছে।
দি মুরস নেক্সট ডোর একজন আলেজরীয়-আমেরিকান। তিনি এই নিষেধাজ্ঞা প্রদানকে ক্ষমতার ক্ষেত্রে এক জটিলতা হিসেবে দেখেন: তিনি মন্তব্য [11]করেছেন:
বিরোধীদের কাছে মিনার আল্পস পবর্তমালায় ইসলামের আগমনের প্রতীক। এর দাঁড়িয়ে থাকা মানে, অন্য ধর্ম ও জনগোষ্ঠীর উপর ইসলামের অবস্থান সুস্পষ্ট হওয়া। এটির উপর নিষেধাজ্ঞা প্রদান করা মানে মুসলিমদেরর ক্ষমতা ও অস্তিত্বের উপর নিষেধাজ্ঞা জারী করা।
…মিনার প্রথমে সৌন্দর্য, পরে ক্ষমতার প্রতীক। মিনার সম্বন্ধে এই সব চিন্তা মাথায় আসে। যে সমস্ত লোকদের মনে কোন বিষয় নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে দ্বিধা রয়েছে, সুনির্দিষ্ট ভাবে তারা, এভাবে নতুন কোন কিছু বাতিল করে।
সিরিয়ার ব্লগার মায়সালূনের এ ক্ষেত্রে একটি আলাদা দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে। এই ঘটনার গুরুত্ব বর্ণনার ক্ষেত্রে তিনি ভিন্ন ভাবনা ভাবছেন। গোঁড়ামিপূর্ণ ভাবনা, ভয় এবং স্থাপত্য বিষয়ক মিথস্ত্রীয়তা বাদ দিয়ে, ব্লগার নিচের যুক্তিটি তুলে ধরেছেন [12]:
সুইসবাসীদের গোঁড়ামি অথবা ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি কিংবা মিনার নামক স্থাপত্যের বিশেষত্ব এই ঘটনায় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। এই ঘটনায় বিশেষ দিক হল ভিয়েনায় অটোমানদের উপস্থিতির বাইরে গত ৪০০ বছরে মুসলিমরা ইউরোপে এই প্রথম এক সত্যিকারের প্রভাব তৈরি করতে সক্ষম হল।
যে ভাবে ইসলাম পশ্চিমের উপর প্রভাব তৈরি করছে বা তার বিপরীত অবস্থান সৃষ্টি করেছে ব্লগার সে বিষয়টি উল্লেখ করছেন: তিনি উপসংহার টানেন এভাবে:
সংক্ষিপ্ত আকারে বলা যায়, আমি গোঁড়ামি, মিনার বা শরীয়ৎ নামক আইনের উপর নিষেধাজ্ঞা প্রদান নিয়ে উদ্বিগ্ন নই, মাথার ঘোমটা খুলে ফেলা যাবে এবং বিশ্বের সকল ব্যঙ্গচিত্র এই তথ্যকে দমাতে পারবে না যে, ইসলাম এখন ইউরোপে প্রবেশ করেছে, এটি এখন আমেরিকা চলে এসেছে এবং এই ধর্ম সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে।
উপসংহারে বলা যায় মৌরিতানিয়ার টুইটার ব্যবহারকারী ওয়েডড্যাডিরমন্তব্যের কথা। তিনি এই সংস্কার ভোটের সারাংশ তুলে ধরেন, যা অনেকের আবেগের প্রতিধ্বনি। তিনি বলেন [13], “এখন কেউ এই ভান করতে পারবে না যে ইউরোপের সাথে মুসলিম সমাজের একটা সমস্যা রয়েছে, তেমনি কেউ অস্বীকার করতে পারবে না যে এখানে ইসলামের উপস্থিতি রয়েছে”।