পাকিস্তান: দক্ষিণ ওয়াজিরিস্তানে অপারেশন

দক্ষিণ ওয়াজিরিস্তান। ছবি উইকিপিডিয়ার সৌজন্যে

দক্ষিণ ওয়াজিরিস্তান। ছবি উইকিপিডিয়ার সৌজন্যে

অপারেশন রাহ-এ-নিজাত (উর্দুতে মুক্তির পথ) হচ্ছে পাকিস্তান সেনাবাহিনী কর্তৃক তেহরিক-ই-তালিবান নামক চরমপন্থী গোষ্ঠীর উপরে শেষ আঘাত হানার সাম্প্রতিক চেষ্টা। তালিবানদের এই দল পাকিস্তানকে ভীতির মধ্যে রেখেছে। এই অপারেশনের কাজ শুরু হয় গত জুন মাসে যখন সেনাবাহিনী সোয়াত উপত্যকা এলাকাকে তালিবান চরমপন্থীদের কাছ থেকে পুনর্দখল করে নেয়। গত ১৯শে জুনে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী দক্ষিণ ওয়াজিরিস্তানে সেনা জড়ো করা শুরু করে। তিন মাসের অবরোধ আর তালিবানের সাথে বিচ্ছিন্ন সংঘর্ষ পর্বের পরে সেনারা পরিশেষে ১৯শে অক্টোবর পুরো দস্তুর যুদ্ধ শুরু করেন। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মোট ২৮০০০ সেনা আর ৫০০ জন বিশেষ কমান্ডো আর তালিবানদের ১০ হাজার থেকে ১৫ হাজার সেনা আর ১৫০০ বিদেশী ভাড়াটে যোদ্ধা এ যুদ্ধে নিয়োজিত আছে। এই সংঘাত জোরালো আর দীর্ঘ হয়েছে আর প্রত্যেক দিন খবর আসছে যে পাকিস্তান সেনা কয়েক ইঞ্চি করে ভেতরে ঢুকছে একটা কঠিন আর বিপদজনক এলাকায়।

পাকিস্তানপাল ব্লগে আহসান ওয়াহিদ দক্ষিণ ওয়াজিরিস্তানের কঠিন ভূমিরূপকে দায়ী করেছেন:

দূরে আল কায়দা যেখানে আশ্রয় নিয়েছে আমরা তা দেখতে পাচ্ছিলাম। এটা প্রায় সাদা ভূমি, শুষ্ক; রাস্তাবিহীন চূড়ার ধার দিয়ে অল্প কিছুর গাছের গুড়িঁ দেখা যাচ্ছে। আপনি লুকাবার কোন জায়গা খুঁজলে ওয়াজিরিস্তান সেটা হবে, কারণ এত কঠিন আর অতিথিবিমুখ যে বাইরের লোকেরা ঢুকতে ভয় পাবে। ব্রিটিশ রাজের সময়ে, ওয়াজিরিস্তানের মানচিত্র অনেকটাই খালি ছিল, এমনকি অকুতভয় ব্রিটিশ ভ্রমণকারীরাও সাধারণত এখানে পা মাড়াতেন না।

গ্রেট সাটান্স গার্লফ্রেন্ড এই অপারেশনের জন্য জনগণকে উদ্বুদ্ধ করার গুরুত্বের কথা বলেছেন:

“আশার মৃত্যুকে কখনো তার ছায়া ফেলতে দেয়া উচিত না, আর এটা তখনই সম্ভব যখন রাষ্ট্র তার সমস্ত কিছু দিয়ে জনগণকে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে একত্র করবে।“

আব্দুল্লাহ সাদ বিশ্বাস করেন যে তেহরিক ই তালিবানে (টিটিপি) যে বিদেশী যোদ্ধারা আছে তারা গায়েব হয়ে যাচ্ছে:

আমার ধারণা হল যে ওয়াজিরিস্তানে অনেক কিছু ঝুঁকির মুখে আছে। কার্যত টিটিপি ক্যাডাররা ঘনবসতিতে চলে আসতে পারে ধীরে ধীরে – খারাপ একটা ভাগ্যের হাত থেকে বা আর একদিন বেশী বাঁচার জন্য… কিন্তু তাদের ‘অতিথি’দের এই আরাম নেই। উজবেক, চেচেন আর আরব ইত্যাদি জায়গা থেকে আগত যোদ্ধাদের যুদ্ধ করতে হবে কারণ তারা ধরা পড়লে, তাদেরকে প্রথম ফ্লাইটে বাড়ি পাঠানো হবে আর উজবেকিস্তানের মতো দেশে, যেখানে তাদেরকে সোজা ফায়ারিং স্কোয়াডে পাঠানো হবে।

নিউমাতিলদার মুস্তাফা কাদ্রি বলছেন যে জঙ্গীদের কাছ থেকে রক্ষা পাওয়া পাকিস্তানের জন্য অসম্ভব:

এই কথার পেছনে অপ্রিয় সত্যটি হচ্ছে মাথা ঠিক রাখার জন্য। লাহোর, ইসলামাবাদ আর পেশাওয়ারে বেশ কিছু সন্ত্রাসী হামলা আমাদেরকে মনে করিয়ে দেয় যে একটা দেশের প্রতি বর্গ ইঞ্চি রক্ষা করা খুব কঠিন যেখানে বিদ্রোহ চলছে। আর পাকিস্তানে এটা প্রায় অসম্ভব, যেখানে বুকে বোমা বাঁধা পরিত্যক্ত তরুণ খুব সহজে পাওয়া যায়।

উপরের বাক্যগুলো খুব বেশী সত্য যেহেতু অপারেশন রাহি-এ-নিজাতের ব্যর্থতা সুধী সমাজের প্রতি সরাসরি আক্রমণ ঘটিয়েছে এবং আত্মঘাতী বোমা হামলা আর সারা দেশে আতঙ্ক আর ভীতি ছড়িয়েও দিয়েছে। এর ফলে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয়া হয়েছে আর সারা দেশের সড়কের নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। আমরা প্রতি দিন সকালে কেবল যে ওয়াজিরিস্তান সীমান্তে যুদ্ধের খবরে চমকে উঠি তাই না বরং আমাদের রাস্তাতেও কিভাবে যুদ্ধ হচ্ছে তার ভয়ঙ্কর ব্যাখ্যাও থাকে।

ব্রিগেডিয়ার (অবসরপ্রাপ্ত) জুনায়েদ জামান ‘পাকিস্তান স্পেক্টেটরে’ দেশে স্কুল বন্ধ করার নিষ্ফলতা নিয়ে লিখেছেন:

আমাদের ভয় পাওয়ার দরকার নেই আর আমাদের বাচ্চাদের ভিতু তৈরি করারও দরকার নেই। আমাদের ছেলে মেয়েদের সাথে আমাদের কথা বলা দরকার, ভীতি সম্পর্কে তাদের সাথে কথা বলা উচিত, তাদেরকে লক্ষ্য রাখতে বলা উচিত, আমাদের দেশ কোন বিপদের মধ্যে আছে সেটা তাদেরকে বোঝানো উচিত আর সন্ত্রাসবাদের খারাপ দিক সম্পর্কে জানাও উচিত। তাদেরকে শক্তিশালী আর সামর্থ করা উচিত আর কষ্টের সময়ে যাতে বাঁচতে পারে সেই শিক্ষা দেয়া উচিত। তারা যখন এই সময় থেকে বের হবে, তারা বিশ্বের অন্যান্য শিশুদের তুলনায় জীবনের মোকাবিলা করতে অনেক দূর এগিয়ে থাকবে।

তারাগানাতে জাররার খান সাধারণ জনগণের ধারণার কথা বলেছেন যারা অন্যান্য কারণকে দোষ দিয়েছেন জনগণের উপর এই হামলার জন্য:

অনেক ছাত্র এটা মানতে রাজি না যে মিলিট্যান্টরা এই আক্রমণের জন্য দায়ী আর তার বদলে ধোঁয়াটে সব শক্তিকে দোষ দিয়েছেন যারা ইসলামকে নীচু করে পাকিস্তানকে দুর্বল করতে চাচ্ছে- অনেক ধরনের চক্রান্ত তথ্য যা বোমা হামলার পরে এখানে শোনা যায়।

বেরি পিকারের গ্লেন্ডা একটা সমাজের মনোবলের কথা বলেছেন যারা সন্ত্রাস সত্ত্বেও জীবন চালিয়ে নিচ্ছে আর তিনি ইসলামাবাদের একটা কনসার্টের কথা বলেছেন:

তাদেরকে বৃহষ্পতিবার রাতে থামতে হয় নি। অন্তত এক ঘন্টার জন্য। আরিব আঝার আর তার চার জনের দল সঙ্গীতের বৈশ্বয়ীকতা, বৈচিত্র আর সহনশীলতার ক্ষমতা প্রদর্শন করেছেন এমন এক শহরে যেখানে মাত্র চার দিন আগে আবারও সন্ত্রাসবাদের ক্ষমতা দেখেছে যা জীবনের কিছু সুন্দর আর সত্য তা প্রকাশের মানুষের ক্ষমতাকে থামিয়ে রাখার জন্য।

বিলকিস অনেক কিছু জানিয়েছেন চুপ (চেন্জিং আপ পাকিস্তান) ব্লগে:

অনেক শিক্ষাবিদ আর রাজনীতিবিদ, বিশেষ করে ইমরান খান তর্ক করেছেন যে এইসব এলাকার লোকেরা অনেক শতাব্দী ধরে আইন বিহীন সমাজে বাস করে আসছেন। এই বাস্তবতার নিরিখে, তারা বলেন, তাদের ঐতিহ্যকে সম্মান করে তার ভিতরেই কাজ করা আমাদের উচিত। আমি অসম্মতি জানাচ্ছি। যেমন টি এস এলিয়ট জানিয়েছেন, ”বুদ্ধি ছাড়া ঐতিহ্য মূল্যহীন।“ এই সমস্ত ঐতিহ্য এমন সব বিষয়কে লক্ষ্য না করায় যার ফলে একটা উদ্দীপ্ত ভাবধারার সৃষ্টি হয়েছে সমগ্র পাকিস্তানব্যাপী, বিশেষ করে গ্রামীণ পাঞ্জাবে। উদাহরণ স্বরূপ সোয়াতে তালিবান যে তরুণীকে বেত্রাঘাত করেছিল সেটাই দেখেন। আমরা কি এমন ঐতিহ্য চাই? আমরা কি পুরুষ/নারী/ মেয়েদেরকে সমস্যা সমাধানের জন্য বদলা-বদলি করতে চাই? আমরা কি চাই আমাদের মানুষ লাগাতার বিশ্ব সম্পর্কে বিকৃত ও সংকীর্ণ একটা ধারণা নিয়ে থাকুক? আমি অবশ্যই চাই না।

তাহলে এখানে আমরা আছি, আশাবাদী, কিন্তু সন্ত্রাস দ্বারা বিদ্ধ, আমাদের স্কুল বন্ধ আর ভবিষ্যত অনিশ্চিত, কিন্তু আমরা হাল ছাড়বো না। আমাদের কেবলমাত্র ভূমির বিপদের সম্মুখীন হতে হবে না আমাদের সেনা দিয়ে বরং আমাদের সমাজে তালিবান মূল্যবোধের নীরব আক্রমণও থামাতে হবে। আমি কেবল আশা করি বিশ্ব আমাদের সাথে আছে, কারণ আমরা ব্যর্থ হলে এর পরে আপনাদের পালা।

আলোচনা শুরু করুন

লেখকেরা, অনুগ্রহ করে লগ ইন »

নীতিমালা

  • অনুগ্রহ করে অপরের মন্তব্যকে শ্রদ্ধা করুন. যেসব মন্তব্যে গালাগালি, ঘৃণা, অবিবেচনা প্রসূত ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকবে সেগুলো প্রকাশের অনুমতি দেয়া হবে না .