ব্লগারদের প্রতিচ্ছবিতে আরব বিশ্বে এইচআইভি/এইডস সচেতনতা

বেশিরভাগ আরব বিশ্বে এইচআইভি/এইডস এক নিষিদ্ধ বিষয়, যদিও ইউএনডিপির হারপাস নামক প্রোগ্রাম এই বিষয়ে সচেতনতা তৈরির চেষ্টা করে যাচ্ছে। এই অঞ্চলের কিছু ব্লগার যেখানে এইচআইভি/এইডস সচেতনতা যে উপেক্ষার শিকার তা নিয়ে রিপোর্ট করছে, সেখানে অন্যরা এই রোগের ক্ষেত্রে যে লজ্জা ও অসম্মান তৈরি হয় তার বিরুদ্ধে এক বিশেষ মাত্রার উন্নয়নে অভিভূত।

মরোক্কো

ডানকান, এক শান্তিরক্ষী বাহিনীর সদস্য যিনি মরোক্কোর এক পানি সরবরাহকারী প্রকল্পে কাজ করছেন এবং যে সমস্ত গ্রামীণ এলাকায় তিনি কাজ করছেন সেখানকার লোকদের এইচআইভি/এইডস এর ব্যাপারে ব্যক্তিগত মনোভাব নিয়ে তার নিজস্ব কিছু ধারণা লিখেছেন। তিনি বিশ্বাস করেন মরোক্কোর সাধারণ নাগরিকদের মধ্যে এইচআইভি বিস্তারের হার খুব কম, তবে সেখানে সামগ্রিক ভাবে পুরো দেশটির ক্ষেত্রে এইচআইভি/এইডস রোগ জনস্বাস্থ্যের জন্য এক হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে।

এই রোগটি সারা দেশে কি ভাবে বিস্তার ঘটাতে পারে তার ক্ষেত্রে বেশ কয়েকটি বিষয় রয়েছে। এইসব বিষয় দেশটিকে এই রোগের ক্ষেত্রে এক ঝুঁকির মুখে ফেলে দিতে পারে।

প্রথমতঃ এই রোগকে উপেক্ষা করা। সাধারণের কথা বলতে গেলে বলা যায়, লোকজন এই রোগ সম্বন্ধে জানে না। যে সমস্ত লোকজন এই রোগের কথা শুনেছে, তারাও এর সম্বন্ধে বিশেষ কিছু জানে না এবং যা জানে, তা ভুল জানে। তারা জানে না কিভাবে এই রোগ ছাড়ায়। লোকজন বলে টুথব্রাশ কারো সাথে শেয়ার করলে এই রোগ ছাড়ায়, হাম্মামখানায় (গণ গোসলখানা) গেলে এবং নি:শ্বাস নেবার মাধ্যমে এই রোগ ছাড়ায়। আমি কাউকে বলতে শুনি নি শারীরিক সম্পর্ক এই রোগ ছড়ানোর অন্যতম মাধ্যম।

দ্বিতীয় বিষয় হল সংস্কৃতির দেওয়াল, যা এই বিষয় নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করতে নিরুৎসাহিত করে। এই সমাজ প্রচণ্ড ভাবে এক ধর্মীয় সমাজ, যেখানে সৎ থাকা এই সম্প্রদায়ের মধ্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কাজেই কনডম ব্যবহারের মতো প্রয়োজনীয় বিষয়কে সামনাসামনি নিয়ে আসা খুবই কঠিন ব্যাপার।

তৃতীয়ত:, (একই সময় তা পূর্বের বিষয়গুলোর সাথে বৈপরীত্য তৈরি করে বলে মনে হতে পারে) দেশটিতে পতিতাদের বিচরণ রয়েছে। এটি বিশেষ করে আমি যে প্রদেশে কাজ করি সেই খেনিফ্রা প্রদেশ তার পতিতালয়ের জন্য বিখ্যাত। আমি শুনেছি, দেশটির যে চারটি শহরে বিখ্যাত পতিতালয় রয়েছে তার মধ্য এই শহর অন্যতম। একটি পতিতালয় আমার আবাসস্থলের কাছে এবং আমি জানি, যে গ্রামে আমি কাজ করি সেই গ্রামের লোকজন এই পতিতালয়ে আসে। তারা আমাকে তা বলেছে। এই সমস্যাটাকে জটিল করেছে এই বাস্তবতা যে এই পতিতালয়ে অনেক যৌন কর্মী শহরের বাইরে থেকে আসে। আমি বিশ্বাস করি এই এলাকা এইচআইভি নামক রোগ ছাড়ানোর এক সহজ স্থান হতে পারে।

সংক্ষেপে বলা যায়, এটা এমন এক বিষয়, যা নিয়ে কথা বলতে লোকজন লজ্জা পায় এবং এই বিষয়ে কেউ কিছু জানে না।

এইচআইভি/এইডস সম্বন্ধে মরোক্কোবাসীদের আরো মনোভাব জানার জন্য এই পোস্ট পড়ুন।

সুদান

গতবছর বাহরাইনের এক ব্লগার সুয়াদ, এইডস সচেতনতা বিষয়ক এক কর্মশালা যা কায়রো শহরে অনুষ্ঠিত হয়, তাতে অংশ গ্রহণ করেন। ব্লগার ভদ্রমহিলা পরে “আয়েশার” গল্প লেখেন। আয়েশা এক সুদানী মহিলা। রক্ত গ্রহণের মাধ্যমে তার শরীরে এইডসের জীবাণু প্রবেশ করে। আয়েশা বর্ণনা করেছে তার অসুস্থ হবার প্রক্রিয়াটি এবং কি ভাবে সে আবিষ্কার করেছে আসলে কি ঘটেছে:

بعد عدة شهور نقص وزني كثيرا ورافق ذلك أعراض أخرى مثل الاسهال المتواصل والتعب والحمى وعدم القدرة على النوم. مرة أخرى تم تحويلي لمختبر لتحليل دمي وهذه المرة جاءت النتيجة في ظرف مختوم بالشمع الأحمر. أخبر الطبيب زوجي بحقيقة مرضي ولكن زوجي لم يصارحني بالأمر وكل ما قاله لي أنه مرض كمرض الضغط والسكري وبأنه لن يكون بإستطاعتنا ان نمارس علاقتنا الزوجية.
بعدها أخذني زوجي لطبيب آخر فتح الظرف امامي وقال لي بأني مصابة بالإيدز، صعقت ولم أملك حينها سوى ان أبكي من هول الصدمة، انا مصابة بالإيدز؟؟ منذ متى وكيف؟ فرد الطبيب: اسألى نفسك، تذكري ماذا ارتكبتي بحق نفسك لتنقلى اليك هذا المرض القاتل. هكذا ببساطة وصمني الطبيب بالمومس دون ان يعرف اي شئ عني. قلت له أنا امرأة متزوجة وليست لدي أى علاقات غير شرعية خارج اطار الزواج وهنا دخلت أمي وزوجي إلى غرفة الطبيب الذي صب جام غضبه على زوجي متهما اياه بنقل المرض لي. شعرت بالغضب الشديد من زوجي فبدأت أهاجمه وأوبخه وانا ابكي، حاول ان يدافع عن نفسه ولكني لم أكن أرغب في سماعه وكانت أمي تحضنني في هذه الاثناء. منذ ذلك اليوم ساءت علاقتي وعلاقة أهلي بزوجي الذي وجُهت اليه اصابع الاتهام حتى ظهرت نتائج الفحص التي بينت ان زوجي وأولادي خاليين من المرض. أعتذرت من زوجي وأدركت حينها ان المرض قد أنتقل لي عن طريق الدم الذي نقل لي في المستشفى.
কয়েক মাস পর আমি প্রচুর ওজন হারাতে থাকি এবং একই সময় এর সঙ্গী হিসেবে আরো কিছু রোগের লক্ষণ দেখা দেয়, যেমন ধারাবাহিক ভাবে ডায়রিয়া, ক্লান্তি, জ্বর, এবং ঘুমা না আসা। আমার রক্ত পরীক্ষা করার জন্য একবার আমাকে এক ল্যাবরেটরিতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। এই বার এই রক্ত পরীক্ষার ফলাফল এক মুখবন্ধ খামে লাল মোম দিয়ে আটকানো ছিল। ডাক্তার আমার স্বামীকে আমার অসুস্থতার সত্য কারণটি জানাল। কিন্তু আমার স্বামী এই বিষয়ে আমার সাথে কোন খোলামেলা অবস্থান নেয় নি। সে আমাকে বলল, এটা রক্ত চাপ বা ডায়াবেটিসের মতো এক রোগ এবং আমরা আর বৈবাহিক সম্পর্ক উপভোগ করতে পারবো না। এরপর আমার স্বামী আমাকে অন্য এক অন্য এক ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেল। যে আমার সামনে সেই খামটি খুলল এবং আমাকে বলল, আমি এইডসে আক্রান্ত। আমি বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলাম। এই বিস্ময়কর আঘাতের ধাক্কা কাটিয়ে উঠার সময় আমার কাঁদবার মতো অবস্থা ছিল না। ডাক্তার আমাকে জিজ্ঞেস করলো… নিজেকে জিজ্ঞেস করে দেখুন, এমন কিছু করেছিলেন কিনা, যার ফলে এই প্রাণঘাতী জীবাণু আপনার শরীরে প্রবেশ করল? এইভাবে ডাক্তার আমাকে নিছক এক পতিতা হিসেব চিহ্নিত করল, আমার সম্বন্ধে কোন কিছু না জেনেই। আমি তাকে বললাম যে আমি এক বিবাহিত মহিলা এবং বৈবাহিক সম্পর্কের বাইরে আমার কোন ধরনের অবৈধ সম্পর্ক নেই। এই অবস্থায় আমার মা এবং স্বামী ডাক্তারের কক্ষে প্রবেশ করলো এবং ডাক্তার সকল রাগ আমার স্বামীর উপর ঝাড়লো এবং তাকে অভিযুক্ত করলো এই রোগ আমার দেহে ছড়ানোর জন্য। আমি আমার স্বামীর উপর রেগে গিয়েছিলাম এবং কাঁদতে কাঁদতে তাকে আক্রমণ ও তিরস্কার করতে শুরু করলাম। সে নিজেকে নিরপরাধ প্রমাণের চেষ্টা করছিল, কিন্তু আমি তার কথা শুনছিলাম না। এই সময় আমার মা আমাকে জড়িয়ে ধরলো। সেদিন থেকে আমার স্বামীর সঙ্গে আমার ও পরিবারের অন্যদের সম্পর্ক তিক্ত হয়ে গিয়েছিল; যতক্ষণ পর্যন্ত ওই সমস্ত পরীক্ষার ফলাফল আসে নি ততক্ষণ পর্যন্ত আমি তার দিকে অভিযোগের অঙ্গুলি নির্দেশ করে থাকতাম, পরীক্ষার ফলাফলে জানা গেল আমার স্বামী এবং সন্তানেরা এই রোগ থেকে মুক্ত। আমি আমার স্বামীর কাছে ক্ষমা চাইলাম, তখন উপলব্ধি করলাম, এই রোগ আমার দেহে এসেছে যে হাসপাতালে আমাকে রক্ত দেওয়া হয় সেখান থেকে।

ইয়েমেন:

ইয়েমেন তার জাতীয় উন্নয়ন কার্যক্রমে এইচআইভি/এইডসকে তালিকায় রেখেছে। কিন্তু গত বছরের একটি পোস্টে ওমার ব্রাসওয়াদা লিখেন, এর জন্য আরো অনেক কিছু করা দরকার

এমনকি যদিও ইয়েমেন, তার আরব প্রতিবেশী রাষ্ট্রের চেয়ে এইচআইভি/এইডস মোকাবেলা অনেক এগিয়ে রয়েছে, কিন্তু সুবিধাদি ও চিকিৎসা সহজ করা ও যারা এ রোগে আক্রান্ত তাদের হাতে যাতে সহজেই ওষুধ পৌঁছে যায় তার ব্যবস্থা করার ক্ষেত্রে তাকে এখনো অনেক কিছু করতে হবে। এইচআইভি/এইডস পরীক্ষার যন্ত্রপাতি দেশের সকল প্রধান মেডিকেল সেন্টার ও ল্যাবরটেরিতে পাওয়া যায়। কিন্তু যখন আপনি এইচআইভি পজিটিভ হিসেবে চিহ্নিত হন, তখনই সমস্যা শুরু হয়; রোগা ক্রান্ত ব্যক্তিটির জন্য তখন সব কিছু কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। সেই মুহূর্তে এইচআইভি/এইডস আক্রান্ত ব্যক্তিকে ইয়েমেনের রাজধানী সানায় যেতে হয়, তাদের সিডি৪ সেল কাউন্ট এবং ভাইরাল লোড পরীক্ষা করার জন্য, এইসব পরীক্ষার মাধ্যমে একজন রোগী কেবল যথাযথ ভাবে এই রোগের চিকিৎসা ও ওষুধ গ্রহণ করতে পারে ও তাকে ঠিকমতো ওষুধপত্র দেওয়া সম্ভব হয়। […] এইচআইভি/এইডস ওষুধের জন্য রোগীকে ভ্রমণ করতে হয়, তাকে নিয়মিত (প্রতি তিনমাস বা প্রায় এই রকম সময়) সানায় যেতে হয় ওষুধ আনার জন্য, কারণ এই সমস্ত ওষুধ ইয়েমেনের অন্য সব ওষুধের দোকান বা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে পাওয়া যায় না। কেউ একজন কল্পনা করতে পারে, কি এক কঠিন অবস্থা ও মানসিক অবসাদ এটা তৈরি করে, যারা ইতোমধ্যে এক মানসিক চাপের মধ্যে রয়েছে তাদের জন্য এ আরো কঠিন অবস্থা। সানার যাওয়ার জন্য অনেক টাকার প্রয়োজন হয় এবং সেখানে খাবার ও থাকার জন্য এমনকি তার চেয়ে বেশি টাকা লাগে। […] তবে দুই বছর আগের সাথে তুলনা করলে বলা যায় অনেক লোক এখন এইচআইভি/এইডস সম্বন্ধে সচেতন। তারপরেও বেশিরভাগ লোকের এই রোগ সম্বন্ধে কোন ধারণা নেই; এবং অনেক লোক এখনো একে অসম্মানজনক ও লজ্জাজনক রোগ হিসেবে বিবেচনা করে, একই সাথে তাকেও একই রকম বিবেচনা করে যে এইচআইভি/এইডস রোগে আক্রান্ত হয়েছে।

মিশর

তবে, মনে হচ্ছে এই অঞ্চলের কিছু দেশে এই রোগকে আলাদা করে দেখার বিরুদ্ধে এক ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। দি ইজিপ্ট গাই সম্প্রতি এক সরকারি পরীক্ষাগারে তার প্রথম এইচআইভি রোগ সনাক্তকরণ পরীক্ষা করেছেন:

আমাকে ডাক্তার যে ভাবে গ্রহণ করেছে তা আমাকে বিস্মিত করেছে। মুল পরীক্ষার জন্য ভালোভাবে আমাকে স্বাগত জানানো হয়। আমি আবিষ্কার করলাম তারা আমার নাম জিজ্ঞেস করল না, তার বদলে একটা ছদ্মনাম দেয় এবং জন্মতারিখ বসায় যাতে তারা আমাকে চিহ্নিত করতে পারে। এরপর আমাকে এক উপদেষ্টার কাছে পাঠায়, যার কাজ এইডস ও এইচআইভি সম্বন্ধে সাধারণ কিছু তথ্য জানানো। আমি যে কিছুক্ষণ পর, আমার দেহে এইচআইভি রোগ আছে কিনা তা পরীক্ষা করতে যাচ্ছি, তা জানার পরও এই ব্যাক্তি কোন ধরনের অশ্রদ্ধার ভাব প্রকাশ করেনি, যা ছিল বিস্ময়কর। আমি সম্প্রতি শুনেছিলাম এইডসকে ট্যাবু বা নিষিদ্ধ বিষয় হিসেবে দেখা হয়, এমনকি ডাক্তারদের ক্ষেত্রেও। এই কাউন্সেলিং বা ধারণা দেওয়ার পর তারা আমাকে বেশ কিছু কনডম ও লূব্রিকেন্ট (এক ধরনের জেলি জাতীয় পদার্থ যা যৌন মিলনে ব্যবহার করা হয়) দিল এবং তিনটি বই, যেগুলোতে এইডস সম্বন্ধে কিছু তথ্য রয়েছে এবং এরপর আমি পরীক্ষা করতে গেলাম। এই পরীক্ষার ফলাফল আমি পরবর্তী রোববারে পাব। আমি আশা করি পরীক্ষার ফলাফল নেগেটিভ হবে, যার মানে বোঝাবে আমার এইডস রোগ হয়নি। আমার জন্য সৌভাগ্য কামনা করুন!!:-)

ও, হ্যাঁ এই সমস্ত কাজের জন্য আমাকে একটি পয়সাও দিতে হয়নি।

এটা ছিল এক চমৎকার অভিজ্ঞতা, যা আমি সরকারি ল্যাব থেকে আশা করিনি। আমি সুখী যে, আমাদের দেশ যৌন পরিবাহী রোগের ক্ষেত্রে আরো অনেক উদার দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করেছে এবং এর ফলে পুরো বিষয়টি বিস্তার লাভ করবে এই সকল লজ্জার বিরদ্ধে, যা এই সমস্ত রোগের সাথে সংযুক্ত, বিশেষ করে এইচআইভি/এইডস নামক রোগের বিরুদ্ধে।

এইচআইভি/এইডস রোগের বিরুদ্ধে মানসিক সংস্কার ভাঙ্গার যে উদ্যোগ মিশরীয় ব্লগাররা নিয়েছে আপনি সে সম্বন্ধে পড়তে পারবেন এখানে

আলোচনা শুরু করুন

লেখকেরা, অনুগ্রহ করে লগ ইন »

নীতিমালা

  • অনুগ্রহ করে অপরের মন্তব্যকে শ্রদ্ধা করুন. যেসব মন্তব্যে গালাগালি, ঘৃণা, অবিবেচনা প্রসূত ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকবে সেগুলো প্রকাশের অনুমতি দেয়া হবে না .