বিশ্বব্যাপী ২৫০০ টি ভাষা হারিয়ে যাচ্ছে

যে সমস্ত ভাষা বিপদে রয়েছে তাদের অবস্থান দেখানো একটি ইন্টারএ্যাকটিভ বা সক্রিয় মানচিত্রে দেখাচ্ছে পৃথিবীতে ২৫০০ থেকে প্রায় ৬০০০ ভাষা বিপদে রয়েছে। এই মানচিত্রটি প্রকাশ করেছে ইউনাইটেড নেশনস এডুকেশন সায়েন্টিফিক এন্ড কালচারাল অর্গানাইজেশন (ইউনেস্কো) নামের সংস্থা। এই আর্ন্তজাতিক সংস্থাটি এই মানচিত্র ব্যবহারকারীদের আহবান জানিয়েছেন তারা যেন এখানে তাদের কিছু মন্তব্য রেখে যায়। তারা এই মন্তব্য এমন এক প্রজেক্টে রেখে যাবে যেখানে অনেক ব্লগার সংস্কৃতি সংরক্ষণ নিয়ে চিন্তিত।

language map
যে সমস্ত ভাষা বিপদের মধ্যে রয়েছে সে সমস্ত ভাষা নিয়ে তৈরী ইউনেস্কোর ম্যাপ

ইগ্লেসিয়া ডেসকালজা একজন গ্রন্থাগারিক এবং ব্লগার:

ভাষাকে ভালোবাসে এ রকম একজন হিসেবে আমি ইউনেস্কো থেকে আসা এই সংবাদে হতাশ। এই মানচিত্রে বিপদে পড়া কিছু ভাষা রয়েছে যা একদিন হয়ত হারিয়ে যাবে। আর্ন্তজাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষ্যে (২১ ফেব্রুয়ারী) এই মানচিত্র প্রকাশ করা হয়েছে। এই মানচিত্রে দেখা যাচ্ছে পৃথিবীতে প্রায় ২০০টির মতো ভাষায় রয়েছে যে সব ভাষায় মাত্র ১০ জনের কম লোক কথা বলে। আবার মানচিত্রে ১৭৮টি ভাষা রয়েছে যে সব ভাষায় ১০ থেকে ৫০ জন মাত্র মানুষ কথা বলে।

এই সমস্ত তথ্য আমাদের জানাচ্ছে ৬০০০ এর মতো যে ভাষা এখনও টিকে আছে তার বাইরে প্রায় ২০০টিরও বেশী ভাষা মারা গেছে। এই ভাষাগুলো মারা গেছে গত শেষ তিন প্রজন্মের মধ্যে। এখন ৫৩৮টি ভাষা বিপদজনকভাবে বিপদগ্রস্ত। ৫০২টি ভাষার অবস্থা খুবই খারাপ। এখনও টিকে থাকা ৬৩২ টি ভাষাকে বলা যায় নিশ্চতভাবে বিপদের মধ্যে রয়েছে। এখনও ৬০৭ টি ভাষা নিরাপদ অবস্থায় নেই।

যখন কোন ভাষায় কথা বলা শেষ ব্যাক্তিটি মারা যায় তখন ভাষাটিও পৃথিবীতে মৃত হয়ে যায়। আইল অফ ম্যান নামের একটি এলাকার ভাষা মানক্স হারিয়ে হয়ে যায় ১৯৭৪ সালে। কারণ এ বছরই এই ভাষায় কথা বলা শেষ ব্যাক্তি নেড ম্যাডরেল মারা যায়। একই ভাবে মার্কিন যুক্তরাস্ট্রের প্রদেশ আলাস্কার আইক নামের ভাষাটিও পৃথিবী থেকে বিদায় নেয় যখন গত বছর মারিয়া স্মিথ জোনস মৃত্যুবরন করেন। তিনিই ছিলেন এই ভাষায় কথা বলা শেষ ব্যক্তি।

আমাদের জীব বৈচিত্র, সাংস্কৃতিক বৈচিত্র, বর্ণবৈচিত্র এবং ভাষাবৈচিত্রকে মূল্য দিতে হবে। কারণ আমরা আমাদের পৃথিবী থেকে আমরা অনেক বেশী কিছু হারিয়ে ফেলেছি। আর এই ঘটনাটি আমরা ঘটিয়েছি একক একটি অংশ হতে গিয়ে, একটি মোটা, সাদা, ইংলিশভাষী সমাজ হতে গিয়ে, এর ফলে আমরা আমাদের বৈচিত্র হারিয়ে ফেলেছি।

হারিয়ে যাওয়া এই সব বেশীর ভাগ ভাষা আদিবাসী মানুষের মুখের ভাষা। বিশ্বায়ন এবং রাষ্ট্রের জাতীয়তাবাদী বোধ এই সব ভাষাকে বিপদের মুখে ফেলে দিচ্ছে। বর্তমানে বৃটেনে বাস করা এক পর্তুগীজের ব্লগ ড্যানিয়েল মুভিং আউট বলছে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা না পেয়েও অনেক ভাষা হারাচ্ছে না কারন:

গালিসিয়ান ভাষা শুনতে অনেকটাই স্প্যানিশ এবং পর্তুগীজ ভাষার মাঝামাঝি। এটি এমন এক ভাষা যা পর্তুগাল থেকে উৎপত্তি এবং স্প্যানিশ ভাষার নানা শব্দ ও উচ্চারনের মাধ্যমে সমৃদ্ধ হয়েছে। এই ভাষাটি মধ্যযুগে গ্যালিসিয়ান পর্তুগীজ ভাষা থেকে জন্মলাভ করে এবং পর্তুগালের প্রায় সব অঞ্চলেই এই ভাষায় কথা বলা হয়।

এই সপ্তাহে ইউনেস্কোর বিশ্বভাষা মানচিত্রটি প্রকাশিত হয়। তাতে দেখা যাচ্ছে গ্যালিসিয়ান ভাষা কোন রাষ্ট্রের প্রধান ভাষা না হয়েও খুবই শক্তিশালিভাবে জনগোষ্ঠীর মাঝে বিরাজ করছে । এটি ক্যাস্টিলিয়ান স্প্যানিশদের নিরাপত্তা মাঝেই বেঁচে রয়েছে। স্পেনের ক্যাস্টিলিয়ানর ভৌগলিকভাবে পর্তুগালের কাছে বাস করে।

যা হোক ব্লগটি ভাষা সম্বন্ধে কিছু বেশ কিছু বিপদজনক তথ্য সারসংক্ষেপ করেছে:

বিশ্বে ১৯৯টি ভাষা রয়েছে, যে সমস্ত ভাষায় এক ডজনেরর কম লোক কথা বলে। ইন্দোনেশিয়ার লেংগিলু ভাষায় মাত্র চারজন লোক কথা বলে (তারা নিজেদের মধ্যে যখন আলাপ করে তখন তারা এই ভাষায় কথা বলে)। ইউক্রেইনের কারাইম ভাষায় কথা বলে মাত্র ছয়জন লোক। পৃথিবীতে প্রায় ২০০-র বেশী ভাষা মাত্র তিন প্রজন্মের মধ্যে হারিয়ে গেছে। বৃটেনের আইল অফ ম্যান এর মানক্স ভাষা মারা গেছে তখন যখন এই ভাষায় কথা বলা শেষ লোকটি ১৯৭৪ সালে মারা যায়।

কিন্তু সকলেই এইভাবে ভাষার হারিয়ে যাওয়া নিয়ে এতটা সচেতন নয়। টিইডি ব্লগে মন্তব্য করার সময় এর ব্যবহারকারী ম্যাগনাস লিন্ডকাভিস্ট বলছেন:

কেন আমরা সকলেই সেই সমস্ত প্রাচীন ভাষার প্রতি রোমান্টিকতা তৈরী করি যাকে আর কোনভাবে যৌক্তিক বলা যায় কি? তাহলে ভাবুন প্রোগ্রামিং এর জন্য তৈরী করা শতশত নতুন ভাষার ক্ষেত্রে কি হবে যা অতীতে মাত্র কয়েক দশক আগে তৈরী করা হয়েছে? অথবা ইংরেজি ভাষার অর্নিদিষ্ট আলাদা রূপ-এর জন্ম লাভ করে বা কি হবে? এই ভাষা জনগণ নানাভাবে মিশিয়ে গ্রহণ করছে এবং নিজেদের মতো করে বানিয়ে নিচ্ছে। তারপরেও তা সারা পৃথিবীতে তার নিজস্ব চেহরা নিয়েই রয়েছে। এ সব ভাষাই আসল ভাষা এবং হারিয়ে যাওয়া সেই সব ভাষা মানাক্স ও তিরাহির চেয়ে এদের প্রতি গুরুত্ব প্রদান করার দরকার বেশী।

আবদুল্লাহ ওয়াহেদ দিবেহী ভাষী। এটি মালদ্বীপের সরকারী ভাষা। দিবেহী যদিও মালদ্বীপের অনেকের নিজের ভাষা নয় তবুও আবদুল্লাহ ওয়াহেদ এই ভাষাকে সরকারী ভাষা হিসেবে সংরক্ষণ করে রাখার সপক্ষে। তিনি তার প্রয়োজনীয়তাকে তুলে ধরেন একটি উদাহারণের মাধ্যমে:

মালদ্বীপ ও মালদ্বীপবাসী একক একটি দেশ ও ভাষী হিসেবে পরিচিত হবার ক্ষেত্রে দিবেহী ভাষাটি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এই দিবেহী ভাষাই হলো একমাত্র মাধ্যম যার মধ্যে দিয়ে মালদ্বীপের বাসিন্দারা একে অন্যের সাথে নিজেদের নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে পারে। এর বাইরে খুব সামান্য পরিমান উপাদান মালদ্বীপকে এক করতে পারে। আমাদের এক গ্রহণযোগ্য অগ্রগতির দিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য এক কৌশলগত উপাদান হলো এই দিবেহী ভাষা। এই ভাষা আমাদের এক করার জন্য এক ঐক্যতান ।

লেখকের জন্য সংরক্ষিত এমন এক লেখার ভাষা ছাড়া, দিবেহী নামের ভাষাটি মালদ্বীপের সকল সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক জীবনের সাথে অঙ্গাঅঙ্গীভাবে জড়িয়ে আছে। আমাদের সকলের কাছে দিবেহী ভাষা একটা বিষয় বটে। যখন আমরা আমাদের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যতার কথা প্রচারণা করতে চাই তখন এই ভাষাই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাড়ায়। যখন আমরা অশিক্ষার বিরুদ্ধে লড়াই করতে চাই তখন এই ভাষা দরকার। যখন আমরা মানসম্পন্ন শিক্ষার কথা বলি, যার মধ্যে রয়েছে স্কুলে প্রথম বছরের শিক্ষা তার জন্য এই ভাষা প্রয়োজন। যখন আমরা বড় কোন সামজিক অন্তুর্ভুক্তির কথা, সৃষ্টিশীলতার কথা, অর্থনৈতিক উন্নয়নের কথা ও যখন আমরা আমাদের আদিবাসীদের সাংস্কৃতিক জ্ঞান রক্ষা করতে চাই তখন এই ভাষা আমাদের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হয়ে দাড়ায়।

আলোচনা শুরু করুন

লেখকেরা, অনুগ্রহ করে লগ ইন »

নীতিমালা

  • অনুগ্রহ করে অপরের মন্তব্যকে শ্রদ্ধা করুন. যেসব মন্তব্যে গালাগালি, ঘৃণা, অবিবেচনা প্রসূত ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকবে সেগুলো প্রকাশের অনুমতি দেয়া হবে না .