ভারত: স্লামডগ মিলিওনেয়ার চলচ্চিত্র নিয়ে প্রতিক্রিয়া

যদি আপনি স্লামডগ মিলিওনেয়ার চলচ্চিত্র সমন্ধে কোন কথা এখনও না শুনে থাকেন তাহলে বেশ কিছুদিন ধরে এই ছবি নিয়ে যে গুঞ্জন চলেছে সে সব থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। মানুষের মুখে মুখে এই ছবি সমন্ধে কয়েক সপ্তাহ ধরে যে প্রচারণা ছড়িয়ে পড়েছে সেসব এখনও আপনার আবিস্কারের অপেক্ষায় রয়েছে।

বিস্ময়কর ছোট বাজেটের এই চলচ্চিত্র এখনও অনেক সিনেমা হলেই প্রদর্শিত হয়নি তবে ইতিমধ্যে এটি চারটি গ্লোন্ডেন গ্লোব এবং ১০টি অস্কার পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছে। খুব সামান্য ১৫ মিলিয়ান ডলার বাজেটের এই ছবিটি তৈরী করেছেন ব্রিটিশ পরিচালক ড্যানি বয়েল। ছবিটি তৈরি হয়েছে বিকাশ স্বরূপ নামের একজন ভারতীয় কুটনীতিবিদের লেখা কিউ এন্ড এ নামক উপন্যাস অবলম্বনে। বেশ কিছু নতুন মুখ এবং চলচ্চিত্র অঙ্গনে এখন নিজেকে প্রমান করতে পারেননি এমন কিছু ভারতীয় তারকা এই ছবিতে অভিনয় করেছেন। তবে এর ব্যতিক্রম হিসেবে এই ছবিতে তারকা অভিনেতা অনিল কাপুর এবং ইরফান খান রয়েছেন।

ছবির কাহিনী (মুল কাহিনীটা বলছি না, আপনারা দেখে নেবেন) গড়ে উঠেছে জামাল নামের এক ছেলেকে নিয়ে। গরিব এই কিশোর মুম্বাইয়ের এক বস্তি থেকে উঠে এসেছে। টিভির এক অসম্ভব জনপ্রিয় গেম শো, ‘কে কোটিপতি হতে চায়’ বা ‘কৌন বনেগা ক্রোড়পতি’ অনুষ্ঠানে জামাল তার ভাগ্য যাচাই করতে চায়। কি ঘটে জামালের জীবনে? সে কি জয়লাভ করতে পারে, নাকি অন্য কিছু ঘটে যায় তার জীবনে?

Danny Boyle
পরিচালক ড্যানি বয়েল, ছবি তুলেছে ফ্লিকার ব্যবহারকারী স্টীট এবং ক্রিয়েটিভ কমন্স লাইসেন্স এর আওতায় ব্যবহৃত

গতবছর আমেরিকা এবং ইউরোপে মুক্তি পাওয়া এ ছবির শ্যুটিং হয়েছে ভারতের মুম্বাই শহরে বেশ কিছু ব্রিটিশ এবং ভারতীয় কর্মী দ্বারা। আমেরিকায় এই ছবিটি সামলোচকদের এবং অন্যান্যদের সবার ভুয়সী প্রশংসা লাভ করে কিন্তু ভারতে এ নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। ছবির সুরকার এ আর রহমান ভারতের একজন নামকরা সঙ্গীত পরিচালক। এই ছবিতেও তিনি তার সুরের চমৎকার ধারবাহিকতা বজায় রেখেছেন। স্লামডগ মিলিওনেয়ার ছবিটির পর্যালোচনা সমন্ধে ও মূল্যায়নের ক্ষেত্রে বিভিন্ন সব আকর্ষণীয় মন্তব্য করা হয়েছে। ভারতীয় চলচ্চিত্রের অন্যতম সুপারস্টার অভিনেতা অমিতাভ বচ্চন তার ব্লগে একে নিয়ে যে মন্তব্য করেছেন তা অনেক বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। ধারাবাহিক ব্লগার অমিতাভ বচ্চন তার ব্লগে এক পোষ্টে এই ছবি সমন্ধে লিখেন:

ব্লগে ম্লামডগ মিলিওনিয়ার চলচ্চিত্র সমন্ধে বিভিন্ন মন্তব্য পড়ে এবং অনেককে এর উপর রাগান্বিত হতে দেখার পর আমি এই মন্তব্য করতে বাধ্য হচ্ছি। যদি স্লামডগ মিলিওনিয়ার দেখায় যে ভারতই কেবল তৃতীয় বিশ্বের একটি নোংরা ও দরিদ্র দেশ এবং ফলে তা জাতীয়তাবাদী এবং দেশপ্রেমিকদের মধ্যে এক তীব্র ব্যথা ও ঘৃণা তৈরী করে তাহলে বলতে হয় উন্নত দেশগুলোতেও এমন ক্ষুধা ও দারিদ্রতা আছে কম পরিমাণে হলেও। স্লামডগ মিলিওনিয়ার আইডিয়া এমন একজন লেখকের মাথা থেকে এসেছে যে একজন ভারতীয় নাগরিক এবং চলচ্চিত্রের জন্য একে বেছে নেয় একজন পশ্চিমা নাগরিক। বিশ্বজুড়ে স্বীকৃতপ্রাপ্ত এক চমৎকার সৃষ্টিশীল এই কাজ অনেকের কাছে হয়ত ততটা সৃষ্টিশীল নয়।

যেমনটি ধারণা করা হয়েছিল যে মিডিয়া এবং ব্লগারদ্বের দ্বারা মি: বচ্চনের মন্তব্য নিবিড়ভাবে যাচাই বাছাই করা হবে তেমনই হয়েছে। জাস্ট জো তার পোষ্ট- ইউ হ্যাভ নো আইডিয়া স্যারজি (আপনার কোন ধারনা নেই স্যার) পোষ্টে লিখছেন, ভারতের বস্তি সমন্ধে মি: বচ্চনের কোন ধারণা নেই। স্লামডগ মিলিওনিয়ার তিনি দেখেননি কিন্তু এই ছবি দেখে মনে হয় যে এই ছবিতে যে বস্তি দেখানো হয়েছে তা সত্যিকারে মুম্বাই, ভারতের বস্তি। তিনি লিখেছেন:

আপনি হয়তো খেয়াল করেননি স্যারজি, হলিউড অনেক লম্বা সময় ধরে তাদের সমাজেরই খারাপ এবং বেদনাদায়ক উপাদান তুলে আনছে। আপনার যুক্তি মোতাবেক হলিউডের ছবি দেখার পর সারা বিশ্বের লোক ভাববে যে আমেরিকা এমন এক দেশ যেখানে কেবল অপরাধী, বর্ণবাদী, ধর্ষক, গর্ভবতী কিশোরী, ড্রাগ বহনকারী ও ভবঘুরে ইত্যাদি, ইত্যাদির বাস। কিন্তু আসলে কি আমেরিকা তাই? তারা চলচ্চিত্রের এই মাধ্যমটিকে চমৎকার ভাবে এই সব অপরাধীরে বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য ব্যবহার করেছে, স্যারজি। এবং এখন এখানে যখন একই কান্ড ঘটানো হচ্ছে তখন আপনি রেগে যাচ্ছেন স্যারজি। ওহ, একই কারনে একসময় আপনি বিখ্যাত ভারতীয় চলচ্চিত্র নির্মাতা সত্যজিৎ রায়ের উপরও রেগে গিয়েছিলেন স্যারজি।

স্লামডগ মিলিওনেয়ার সমন্ধে প্রথম পোষ্ট লেখার পর জনাব অমিতাভ বচ্চন তার মন্তব্যকে যুক্তিযুক্ত করার জন্য ছবিটির পরিচালক ড্যানি বয়েল এবং অভিনেতার অনিল কাপুরের সাথে কথা বলেন এবং আরেকটি পোস্ট দেন

নন্দন নিলেকানি ভারতে অন্যতম বৃহৎ আইটি কোম্পানী ইনফোসিস এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রতিষ্ঠানটির প্রধান। তিনি তার ব্লগে একটি কৌতুহলজনক পোষ্টে জানাচ্ছেন কিভাবে ভারতীয় চলচ্চিত্র বর্তমান প্রজন্মের ধ্যানধারণাকে গুরুত্বের সাথে তুলে ধরেছে। নিলেকানী ১৯৭০ দশকের চলচ্চিত্র এবং স্লামডগ মিলিওনেয়ার এর মধ্যে তুলনা করে দেখেছেন এবং তিনি এই দুই প্রজন্মের দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য দেখাচ্ছেন।
তিনি লিখছেন:

উৎসাহ প্রদানের ক্ষেত্রে এই চলচ্চিত্রটি সবার হৃদয়ের মধ্যে রয়েছে, এবং এই ছবিতে স্বপ্ন যেন সত্যি হয়ে এসেছে। এ যে একজন অতি সাধারন মানুষ জামাল, সে ১৯৭০-এর দশকের মতো ভারতীয় চলচ্চিত্রের একজন রাগী নায়ক নয়। সে একই সাথে আশাবাদী এবং ক্রমাগতভাবে লড়াকু মানুষ যে নির্দিষ্ট পথে এগুচ্ছে। সে জানে তার শেকড় কোথায়। এমনকি তার চারপাশে যারা থাকে তারাও তাকে স্লামডগ বা বস্তির কুত্তা বলে ডাকে। সে জানে এটি কোন বিষয় নয় যে সে কোনখানে জন্ম গ্রহণ করেছে, সে জানে তাকে কোথায় যেতে হবে এবং সেটিই হলো তার স্বপ্ন।

কিন্তু ভারতের তরুণরা আসলে এই ছবি নিয়ে কি ভাবছে? তারা কি ভাবছে এটি কি আশাবাদী ছবি যা অনুপ্রেরণা যোগায়? ভাব দেখে মনে হচ্ছে না সকল ভারতীয় তরুণ এই ছবির আশাবাদী দিকটা ধরতে পেরেছে। দেশিক্রিটিক্স এর পিএইচ লিখছেন তিনি স্লামডগ মিলিওনেয়ার ছবিটিকে জীবনের সাথে সম্পৃক্ত এবং দিকনির্দেশনা পূর্ণ কিছু মনে করছেন না:

আমেরিকার দক্ষিণের নায়কদের মতো জামাল বর্তমান ভারতীয় ইতিহাসে তার সময়ের সবার প্রতিনিধিত্বমূলক কণ্ঠস্বর হতে পারে নি। আমরা কখনওই তার স্বর থেকে কখনও অন্য কারো কণ্ঠস্বর বেরিয়ে আসতে শুনেনি কিংবা অন্য কারো কৌতুহলপূর্ণ কোন গল্প, যা বাইরের কেউ একজন বলছে—-। এই সকল বিষয়ের ক্ষেত্রে স্লামডগ মোটামুটি মানের হয়ে আমাদের আশাহত করেছে। ছবিটি না হয়েছে একটি রূপকথা না ধরতে পেরেছে শহুরে দারিদ্রকে সঠিকভাবে তুলে ধরতে। উভয়দিক দিয়েই এটি ব্যর্থ হয়েছে।

পিএইচ শেষ করেছে এই বলে:

ছবিটি একটি তিতা সসে মিষ্টি খাবার রান্না করার চেষ্টা।

একবছর ভারতে অবস্থান করা এক ভারতীয় আমেরিকান তরুণী মিরা সিনহা এই ছবিটি দেখেছেন। তিনি মুম্বাইয়ের বস্তিবাদীদের প্রতিবাদের দিকে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে তাদের প্রতিবাদের কথা জানান। তারা স্লামডগ নামের মধ্যে দিয়ে তাদের পরিচিত করার কারনে প্রতিবাদ জানিয়েছে। আরো গুরুত্বপুর্ন বিষয় হলো মিরা এই ছবিটি যে বির্তক তৈরী করেছে সে সমন্ধে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে লিখছেন:

জনপ্রিয় বিনোদন সংস্কৃতি নিয়ে এই ধরনের স্বাস্থ্যকার সমালোচনা মিডিয়া আমাদের সকলকে কিভাবে উপস্থাপন করে এবং মিডিয়ার সাথে আমাদের সম্পর্ক কি তা বুঝতে সাহায্য করে।

লোকজন এই ছবিটিকে পছন্দ করুক বা না করুক, ঘটনা হচ্ছে যে স্লামডগ মিলিওনেয়ার ভারতে দারিদ্রতা, উদ্যোক্তা হবার চেষ্টা এবং ভারতীয় চলচ্চিত্র নিয়ে আলোচনার জায়গা তৈরী করে দিয়েছে। আশা করি এই আলোচনা এক ধনাত্মক ফল বয়ে আনবে।

এখানে উপস্থাপিত থাম্বনেইল ছবিগুলো ফ্লিকার ব্যবহারকারী রিচলিউডিকিউ এর সৌজন্যে এবং ক্রিয়েটিভ কমন্স লাইসেন্স এর আওতায় ব্যবহৃত।

আলোচনা শুরু করুন

লেখকেরা, অনুগ্রহ করে লগ ইন »

নীতিমালা

  • অনুগ্রহ করে অপরের মন্তব্যকে শ্রদ্ধা করুন. যেসব মন্তব্যে গালাগালি, ঘৃণা, অবিবেচনা প্রসূত ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকবে সেগুলো প্রকাশের অনুমতি দেয়া হবে না .