দীর্ঘদিন ধরে মুক্ত ভাষ্যের বাহক হিসাবে পরিচিত বিবিসির সততা ও নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন করছে আরব বিশ্ব ও আশে পাশের ব্লগাররা। কারন সম্প্রতি গাজায় ইজরায়েলি যুদ্ধে আহতদের জন্য একটা আবেদন প্রচার করতে বিবিসি অস্বীকার করেছে।
এই বিতর্ক শুরু হয় যখন বিবিসি যুক্তরাজ্য ভিত্তিক ডিজাস্টার ইমারজেন্সি কমিটি (ডিইসি) কর্তৃক নির্মিত এই ভিডিওটি প্রচার করতে অস্বীকার করে এই বলে যে এটা প্রচার করলে তাদের নিরপেক্ষতা হুমকির মুখে পড়বে। এই সংস্থা মানবাধিকারভিত্তিক দাতা সংস্থা অক্সফ্যাম, সেভ দ্যা চিল্ড্রেন আর রেড ক্রসের একটা সহপ্রতিষ্ঠান।
সরকারী নিয়ন্ত্রণহীন প্রচার মাধ্যম স্কাই নিউজ ও এই সাহায্যের আবেদন প্রচারে অসম্মতি জানায়। অথচ রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন চ্যানেল ৪ আর বেসরকারী চ্যানেল আইটিভি আর চ্যানেল ৫ প্রচার তা করেছে- যার ফলে প্রতিবাদকারীরা রাস্তায় আর ব্লগাররা তাদের কিবোর্ডের মাধ্যমে এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানিয়েছে।
আমেরিকান-ফিলিস্তিনি ব্লগ কাবোফেস্টে এক লেখায় জিলিয়ান বলছেন:
মুলত: এখানে সমস্যা হলো বিবিসির ধারণা যে তাদের ইচ্ছা ‘নিরপেক্ষ’ থাকা। এটা বুঝিয়ে দিয়ে যে তারা মানবাধিকারের সমস্যা আর গাজার আহতদেরকে অবজ্ঞা করবে যাতে পক্ষপাতের দিকে তাদের কোন ভুল না হয়। আসলে তাদের কার্যক্রম বোঝায় ইজরায়েলের গণহত্যার কারনে ৫০০০ আহত মানুষ আর অগুণতি লোক যারা নিজেদের বাড়ি হারিয়েছে বা কাজ হারিয়েছে তাদেরকে সাহায্য করার থেকে যে ইজরায়েলকে ক্ষুব্ধ না করাই আসলে তাদের কাছে বেশী গুরুত্বপূর্ণ।
নিউজ ফ্রম সিরিয়া বলেছে যে বিবিসি ডিইসি এর আহ্বান আগে প্রচার করেছে, রাজনৈতিকভাবে উত্তপ্ত পরিস্থিতিতেও। এই ব্লগ জানিয়েছে:
বিবিসি ডিইসির প্রত্যেকটি আহ্বান আগে দেখিয়েছে। আর তারা তা বড় ধরনের রাজনৈতিক প্রভাবযুক্ত মানবাধিকার দুর্যোগের (যেমন যুগোস্লাভিয়ার) ক্ষেত্রেও এমন আবেদন দেখিয়েছে।
কিন্তু এটা নিষিদ্ধ করে বিবিসি অর্থের জন্য আবেদনের থেকে বেশী কিছুকে আঘাত করেছে। তারা ডিইসির নিরপেক্ষ কাজকে রাজনীতিকরন করছে- যার মধ্যে অক্সফাম, রেড ক্রস আর সেভ দা চিল্ড্রেনের মতো সংস্থাও জড়িত আছে।
একই ধরনের দাবি করেছে গাজায় বিবিসির অফিসের বাইরে বিক্ষোভরত প্রায় ৩০ জন প্রতিবাদকারী। আন্তর্জাতিক সংহতি মুভমেন্ট অনুসারে:
বিক্ষোভকারীরা বিবিসির দাবিকে নাকচ করে দিয়েছে যে এই আহ্বান দেখালে তাদের নিরপেক্ষতা প্রশ্নের সম্মুখীন হতো- অনেক উদাহরণ দিয়ে যেখানে অসংখ্য ডিইসি আহ্বান জরুরী সাহায্যের দুযোগপূর্ণ এলাকায় এই স্টেশন বিনা প্রশ্নে দেখিয়েছে। বক্তারা বিবিসিকে অভিযুক্ত করেছে যে এই প্রতিষ্ঠান বর্ণবাদী বিভাজনের দ্বৈত নীতি অনুসরন করে প্যালেস্টাইনের কোন ব্যাপার আসলেই।
ওদিকে গাজা থেকে মোমেন্টস ইন গাজা বিক্ষোভ সম্পর্কে বিস্তারিত জানিয়েছেন আর লিখেছেন:
মানুষ গৃহহীন, ক্ষুধার্থ আর গাজার চারপাশে হাসপাতালে আছে। তাদের জন্য মানবাধিকার সাহায্য চাওয়া ‘পক্ষপাতপূর্ণ'? নোংরা বস্তুনিষ্ঠতার ব্যাপারে কি আর বলা! কি লজ্জা।
মরোক্কান ব্লগার হিশাম, যিনি মিররের দায়িত্বে আছেন, বিবিসির উপরে রেগে বলেছেন:
গাজায় রক্তক্ষয়ী আগ্রাসনের প্রথম থেকে বিবিসি ছিল গাজার প্রতিরোধহীন মানুষের উপরে যে বিভীষিকা নেমে এসেছে তার ব্যাখ্যা দেয়ার ক্ষেত্রে বরাবরের মতো ‘নিরপেক্ষতার’ নামে দারুণ পরিষ্কার। একটা ‘প্রতিরোধমূলক আক্রমনের’ কথা বলল তারা যখন এটা পরিষ্কার ছিলো যে এটা পূর্ব পরিকল্পিত আক্রমণ আর নাগরিকদের বুঝে শুনে হত্যা। ‘যুদ্ধের’ কথা বলছে যেন সংঘাতরত বাহিনীদুটো কোনভাবে তুলনা যোগ্য। অপরাধ স্থলে আর্ন্তজাতিক সাংবাদিকদের যাওয়া নিষিদ্ধ করা সংক্রান্ত ইজরায়েলের খবরদারী মেনে নিয়েছে তারা বড় কোন প্রতিবাদ না করেই। অথচ ইজরায়েলের মূখপাত্রকে স্থান দিয়েছে, যেটা অবশ্য আইনের মধ্যে, কিন্তু এই প্রপাগান্ডা কাজকে কোনরুপ প্রশ্নবিদ্ধ না করে তা করা হয়েছে।
ইজরায়েল থেকে গয় এই সংঘাত নিয়ে আলোচনার সুযোগে মিডিয়ার ‘বস্তুনিষ্ঠতা’ নিয়ে আলোচনা করেছেন। তিনি লিখেছেন:
বিবিসি অনেক সময়ে তাদের সংবাদকে ব্যাখ্যা করার জন্য ‘বস্তুনিষ্ঠ’ কথাটা ব্যবহার করে। বস্তুনিষ্ঠতা যখন সাংবাদিকতার বেলায় আসে, তখন তা উদ্ভট। এটা বোঝায় যে সাংবাদিকদের নেই আর থাকার সামর্থ নেই যে ব্যাপারে তারা রিপোর্ট করছে সে ব্যাপারে কোন মতামত থাকার, বরং তথ্য যা আছে শুধু তাই জানানো।
যদি এটা সম্ভব ও হতো- আর এখানে আমি ব্যক্তিগত ব্যাখ্যা থেকে যে বিষয়বস্তু আসে তা জানানোর কষ্ট করবো না – জিনিষ হচ্ছে বিবিসি সব সময়ে সম্পাদকীয় করে, মতামত আর মন্তব্যকে তথ্যপ্রমাণ হিসাবে প্রচারের জন্য। আপনি একটা খবর শোনেন- যে কোন একটা – আর আমাকে বলেন যে আমি ভুল বলছি।
আর একজন ইজরায়েলী ব্লগার, দ্যা এল্ডার অফ জিওন এই সাহায্যের আবেদনটিকে না দেখানোর ব্যাপারে বিবিসির সিদ্ধান্তকে ‘অদ্ভুত’ বলেছেন আর যোগ করেছেন:
যে কেউ যারা দেখেছেন বিবিসি কিভাবে ইজরায়েলকে কভার করে তারা এই অদ্ভুত যুক্তির ব্যাপারে না হেঁসে পারবে না। গাজাবাসীদের সাহায্যের জন্য যে মিলিয়ন ডলার খরচ করা হচ্ছে সে সম্পর্কে ইজরায়েলি আর জিওনিস্টদের কোন অসুবিধা নেই, কেবলমাত্র সরাসরি বা অন্যভাবে হামাসকে দেয়া মিলিয়ন ডলার নিয়ে আছে। ইজরায়েল নিজেই অনেক সময়, শ্রম আর অর্থ ব্যায় করে গাজাবাসীদের সাহায্যের জন্য। ইজরায়েল কখনো হু, রেড ক্রস বা অন্য কোন সাহায্য সংস্থা থেকে গাজাবাসীদের সাহায্য যাওয়ার ব্যাপারে প্রতিবাদ করেনি।
অদ্ভুতভাবে, এই সিদ্ধান্ত নিয়ে বিবিসি নিজেদেরই ইহুদী বিরোধী মনোভাবকে প্রতারণা করেছে। যখন কোন ইহুদী বা জিওনিস্ট দল বিবিসিকে বলেনি এই আহ্বান না দেখাতে, তারা ধারণা করলো যে হিংসুটে, ক্ষমতাশালী ইহুদিরা গাজাবাসীদের অর্থ দিলে ক্ষেপে যাবে। এইসব কাল্পনিক প্রতিবাদের মুখোমুখি না হয়ে, বিবিসি ভাবলো যে তাদেরকে একটু খেলানো যায়, আবেদনটি প্রচার না করা আর এটাকে তাদের ‘বস্তুনিষ্ঠতার’ প্রমাণ হিসাবে ব্যবহার করা।
এরই মধ্যে ফেসবুকে বেশ কয়েকটা গ্রুপ উতৈরি হয়েছে এই ব্যবহারের প্রতিবাদে, যার মধ্যে অন্যদের মধ্যে আছে ‘বিবিসিতে অনেকে মিলে প্রতিবাদ‘ আর ‘আমি বিবিসিকে তিরষ্কার করি গাজার যুদ্ধ নিয়ে তাদের ইজরায়েলের পক্ষে প্রচারের জন্য‘।