নতুন এক বিরোধ বাংলাদেশে দানা বেঁধে উঠেছে গত সপ্তাহে। ইসলামবাদী একটা দলের প্রতিবাদের মুখে বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষ বাধ্য হয়েছে পাঁচজন বাউলের (মরমী লোক সংগীত শিল্পী) ভাস্কর্য অপসারণ করে ফেলতে যার মধ্যে জিয়া আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের সম্মুখে নির্মাণাধীন ফকির লালন শাহের ভাস্কর্যও রয়েছে। ইসলামবাদীরা মুর্তি প্রতিরোধ কমিটি তৈরী করে সোচ্চার হয়েছে বিমানবন্দরের সামনে কোন ভাস্কর্য তৈরী না করতে দিতে। এর পাশেই হাজি ক্যাম্প অবস্থিত হওয়ায় তারা চায় না ভাস্কর্য দেখে হজ্ব যাত্রীরা তাদের যাত্রা শুরু করুক। আল্লাহ, নবী অথবা পীর-আউলিয়াদের প্রতিনিধিত্ব করে এমন কোন বস্তু বা চিত্রের উপাসনা করা ইসলামে অনুমোদিত নয়। কিন্তু মুসলিম বিশ্বে ভাস্কর্য ভিন্ন সংস্কৃতি উপাস্থাপনা করে এবং বিশ্বব্যাপী সর্বত্রই এমন ভাস্কর্য দেখা যায়।
ভাস্কর্যের অপসারণ এবং সরকারের নিষ্ক্রিয়তা বাংলাদেশে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে। বাংলাদেশী ব্লগস্ফিয়ারও এই ইস্যুতে উত্তাল:
বাংলা ব্লগিং প্লাটফর্ম সচলায়তনে একজন অতিথি লেখক উল্লেখ করেছেন:
এয়ারপোর্ট একটি দেশের আন্তর্জাতিক প্রবেশ দ্বার। সবাই চাইবে তার দেশের শিল্প-সংস্কৃতি-ঐতিহ্য কে এখানে সংক্ষেপে তুলে ধরতে। লালন কি কোন ধর্মের মুর্তি? আমার প্রিয় স্বদেশ কি গুটিকয়েক (অসীম!) শক্তির লোকের কারণে অসাম্প্রদায়িক থেকে উগ্র ধর্মীয় দেশের পরিচয় লাভ করবে?
কৌশিক আহমেদ লিখেছেন:
একজন লালন আমাদের বাঙালীত্বের মানবিক স্ফূরণ সম্পাদন করেছেন, সাম্প্রদায়িকতার ঊর্ধ্বে অনুভবের বাস্পায়ন ঘটিয়েছেন। লালন আজ সেই সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্পে স্খলিত। [..]
ভাষ্কর্য ভাঙা ও মোল্লাদের আবার সংঘ-শক্তি প্রদর্শনে মধ্যবিত্ত বাঙালি মুসলমানদের অনেকেই পরিমিতভাবে বিরক্ত। অনেকেই মৃদুস্বরে ধৈর্যের সাথে প্রতিবাদী কথা বলবার চেষ্টা করছেন।
মুর্তি অপসারণ করা হচ্ছে: ছবির কৃতিত্ব বাংলার জয়ের
ব্লগার বাংলার জয় লিখেছেন:
লালন নয় আমাদের গোটা বাঙালির জন্য অভিশপ্ত অধ্যায় (এটি)! [..] গোটা কিছু পাগড়ী আর উর্দি পরিহিত ফতোয়াবাজদের কাছে চরম ভাবে লাঞ্চিত দেশ, জাতি আর বিবেক! আমাদের সরকার নীরব, জাতির বিবেকবান মানুষ আজ মৃত।
সাংবাদিক জাহাঙ্গীর আলম আকাশ স্মরণ করিয়ে দেন দেশে এখন জরুরী অবস্থা বিরাজ করা স্বত্বেও এই মৌলবাদীদের সরকার অব্যাহতি দিয়েছে।
ওরা জরুরী অবস্থা মানে না কখনই। ওরা ধর্মকে পুঁজি ও ব্যবহার করে যখন যা খুশি তাই করে থাকে। আমাদের কালো বাহিনী, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কেউ তাদের ধরে না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা অপরাজেয় বাংলার মুর্তির চোখ বেঁধে প্রতিবাদ জানাচ্ছে। লাল দরজার সৌজন্যে আলোকচিত্রটি প্রাপ্ত।
ফারুক হাসান জিজ্ঞেস করেছেন:
এত কিছু থাকতে এখন ভাষ্কর্য নিয়ে টানাটানি কেন? দেশে তো অনেক ভাষ্কর্য আছে। এখন কি সব ভাষ্কর্যই সরিয়ে ফেলতে হবে? হজ্জ্বযাত্রীরা তো উত্তরবঙ্গ থেকেও আসবেন, সেক্ষেত্রে আমরা কি গাজীপুর চৌরাস্তার ‘জাগ্রত চৌরঙ্গীর’ সেই দৃপ্ত মুক্তিযোদ্ধার ভাষ্কর্যও ভেঙ্গে ফেলবো? বকশিবাজার থেকে যদি কোনো হজ্জ্বযাত্রী বিমানবন্দরের দিকে আসতে চান তাহলে কি আমরা টিএসসি মোড়ের রাজু মনুমেন্ট ভেঙ্গে ফেলবো? যদি এদের না ভেঙ্গে ফেলি তাহলে লালন কি দোষ করলো?
যূথচারী ব্যাখ্যা করেছেন ভাস্কর্যে লালন শাহের প্রতিকৃতি করা হচ্ছিল না এটা ছিল সমস্ত বাউল শিল্পীদের প্রতিকৃতি:
বিমানবন্দর সড়কে মৃণাল হক যে ভাস্কর্যটি নির্মাণ করছিলেন তার নাম ছিল “খাঁচার ভিতর অচিন পাখি” হলেও ভাস্কর্যটি লালনের নয়। আর লালনের মূর্তি করা সম্ভবও না কেননা তার কোনো ছবি বা স্কেচ নাই।
“সাম্প্রদায়িকতা অথবা মত প্রকাশের স্বাধীনতা? কোন পথে সরকার?” সড়কে প্রতিবাদী শ্লোগান। লাল দরজার সৌজন্যে প্রাপ্ত।
মাহবুব মোর্শেদ আশঙ্কা করেছেন [বাংলায়] এর ভেতরে গভীর এক রাজনৈতিক চাল থাকতে পারে। কাকতালীয়ভাবে এ সময়টা মিলে যায় এমন একটা মুহূর্তের সাথে যখন একটা ধর্মীয় দলের একজন শীর্ষ নেতার গ্রেফতারী পরোয়ানা বাস্তবায়নের জন্য সরকার প্রচন্ড চাপের মুখে পতিত।
রাজর্ষী লিখেছেন:
এসবই সাম্প্রদায়িক রাজনীতির কুটচাল। এগুলো অনেক আগেই শুরু হয়েছে এদেশে। এভাবে ধর্মকে ব্যবহার করে বিগত কয়েক দশকে কয়েকটা মুফতি (আমীনি, শা হাদিস) নেতা, সাংসদ হয়ে গেছে।
মাহি রাহী বলেছেন:
আমাদের দেশের কিছু ধর্মীয় গুরু আছেন তারা মনে হয় সবসময় একপায়ে খাড়া আছেন মুর্তি দেখলেই তা ভেংগে গুড়িয়ে ফেলার জন্য। কিন্তু তাদের মনে যে লোভের মুর্তি, খ্যাতির মুর্তি আর ক্ষমতার মুর্তির যে প্রতিনিয়ত পুজা চলে, তাকি তারা কখনো ভাংগতে পারবেন।
ভাস্কর্য অপসারণের প্রতিবাদে ঢাকায় অনুষ্ঠিত মানব বন্ধনের ছবি দিয়েছেন ব্লগার অণৃন্য।
নজরুল ইসলাম স্মরণ করেছেন কিভাবে তিনি স্কুলের অনুষ্ঠানে লাইভ ভাস্কর্য সাজতেন এবং বলেছেন:
খুব ইচ্ছা করতেছে বিমানবন্দর চত্বরে সেই বালকবেলার মতো মূর্তি সেজে দাঁড়িয়ে থাকতে। একতারা হাতে…
মুর্তি অপসারণে জন্যও কিছু মতামত উঠে এসেছে। ব্লগার বর্ণ লিখেছে:
মূর্তির সাথে চেতনার কি সম্পর্ক? লালন যদি তার লেখনি দিয়ে মানবতার জন্য কিছু করেই থাকেন তো লালনের গানই লালনকে মানুষের হৃদয়ে স্থান দেবে। এ জন্য মূর্তি বানাতে হবে কেন?
প্রকৃতপক্ষে, ব্যক্তির কাজই তাকে মানুষের হৃদয়ে স্থান দেয়, মুর্তি নয়।
লালন ফকিরের গান বাংলাদেশের রক গানকেও প্রভাবিত করেছে এবং তার কিছু গান জনপ্রিয় আধুনিক ফোক রক গানে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশের রক গানের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব মাকসুদুল হক পরামর্শ দিয়েছেন প্রতিবাদের অস্ত্র হিসাবে চুপ থাকতে:
মোল্লারা এবং রাজনৈতিক প্রেক্ষিত যৌথভাবে চায় আমাদের প্রতিক্রিয়াশীল দেখতে এবং তাদের প্রতিক্রিয়াশীল চরিত্র ধারণ করতে। আমরা তাদেরকে মনে করি না “গুরুত্বপূর্ণ প্রতিদ্বন্দ্বী” অথবা “গুরুত্বপূর্ণ বিপক্ষ দল” অথবা “গুরুত্বপূর্ণ যোদ্ধা”। শুধুমাত্র আমরা বলি এটা হতে দিতে হবে – কিন্তু সম্মিলিত দাবী নিয়ে আমরা সর্বাগ্রে হাজির হই না অথবা দাবী জানাই না আমাদের পূর্বপুরুষদের কোন স্মৃতিস্তম্ভের অথবা পিতৃপুরুষদের… করেছি কি?
বাউল অথবা সামাজিক-আধ্যাত্মবাদী ভাবনার বাঙালী দর্শন প্রতিবাদকারীদের লক্ষবস্তু নয়। তাদের উদ্দেশ্য এবং আশা খুবই সংকীর্ণ – ঝড়ে বক মেরে বাউল ইস্যু দিয়ে ক্ষীণ রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করা; রাষ্ট্রের ক্ষমতা কুক্ষিগত করে বিরাজিত অস্থিতিশীলতাকে আরো জটিল করে তোলা।
মানব ইতিহাসে এটা খুবই প্রাচীণ খেলা হিসাবে পরিচিত এবং অসংখ্য বাউল গানে যার প্রতীকি ব্যঞ্জনা ফুটে উঠেছেঃ:
চোরকে বলে যাও করতে চুরি
চাষাকে বলো ধরতে
মানবসন্তানেরে কেন তবে বলো রে পাপী?দয়া করে শান্তি বজায় রাখুন, কেবল ছড়িয়ে দেন সংবাদটি, লড়াই থামালে চলবে না।
মৃগেন্দ্র স্বীকার করেন:
তবে ভাস্কর্য থাকুক আর না থাকুক লালন জীবিত আছেন। নিযুত হৃতস্পন্দনে তিনি জীবিত থাকবেন। কোন **বিমানবন্দর গোলচত্বর মুর্তি প্রতিরোধ কমিটি** সেই লালন দড়ি দিয়ে টেনে নামাতে পারবে না।
* লালন শাহের এই থাম্বনেইল চিত্রটি নেয়া হয়েছে উইকিপিডিয়া থেকে।
3 টি মন্তব্য
আমি এই সাইটি আজিই প্রথম দেখেছি এবং এটা আমার প্রথম মন্তব্য। এখানে কিছু কথা না বলে পাছিরনা, আমি কখনো রাজনীতি করিনি এবং দেশের বাইরে থাকার কারনে ভোটার হয়েছি কিন্তু কখনো কাউকে ভোট দিতে পারিনি। যারা এই কাজটি করেছে তাদের উদ্দেশ্য আমি জানিনা, তবে লালনের কোন মূর্তি যখন এখানে দেওয়া হয়নি, তাহলে কিভাবে এটা লালনকে ধংস করা হল। আমাদের দেশের ভাস্কর্য শিল্পীরা তাদের অমূল্য মেধা দিয়ে শুধু মূর্তিই তৈরী করেন কেন? অপনারা কি পারেন না পৃথীবির প্রাচীনতম, নাম করা অথবা নিজের মনের আংকিত কোন মসজিদ বা মসজিদের মীনারের ভাস্কর্য তৈরী করতে। যেটা পরে বাস্তবিক ভাবে মসজিদে পরিনত হতে পারে এবং যারা ইসলামের নামে মূর্তি ভাংচুর করে রাজনৈতীক ফয়দা লুটছে তারা আর কখনো এই সুযোগ পাবেনা।
আপনারা যতই বিষয়টা সত্যায়িত করার চেষ্টা করেন না কেন, ইসলামে শিল্প বা অন্য কোন কিছুর নামেও তথাকথিত ভাস্কর্য বানানোর উপায় নেই। তাই মোল্লাদের দায়িত্ব তারা পালন করেছে।
বাংলাদেশের মত দেশে বাস করতে হলে মোল্লাদের দাপট সহ্য করতেই হবে। যম্মিন দেশে যদাচার।
“ইসলামে শিল্প বা অন্য কোন কিছুর নামেও তথাকথিত ভাস্কর্য বানানোর উপায় নেই” কথাটি মনে হয় ঠিক না। ধর্মে পৌত্তলিকত্ব নিষিদ্ধ আছে, শিল্প সম্পর্কে বলা নেই। ইসলামী রাষ্ট্রগুলো যেমন সৌদি আরবেও ভাস্কর্য বিদ্যমান আছে। যদি নিষিদ্ধই হতো তাহলে ওগুলো কিভাবে থাকে?
বাংলাদেশ কি ধর্মীয় একনায়কতন্ত্র ও শরিয়া মেনে চলে? নাকি এটি গনতন্ত্রের দেশ এবং ধর্মীয় সংখ্যালঘুদেরও আমলে নেয়া হয়? মোল্লাদের এই শক্তির উৎস কি? আমরা হার মেনে বসে থকলে অসত্যেরই জয় হবে।