বাংলাদেশ: আপোষকৃত প্রচারমাধ্যম

সামরিক বাহিনী সমর্থিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যখন থেকে বাংলাদেশে জাঁকিয়ে বসল প্রচার মাধ্যমের পরীক্ষাও শুরু হলো। ২০০৭ এর জুনে হিমাল সাউথ এশিয়া ম্যাগাজিনের এক বিশেষ প্রতিবেদন উল্লেখ করেছে যে বাংলাদেশের বাংলা ও ইংরেজী প্রচার মাধ্যম বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছে:

সামরিক শাসনের সময় বাংলাদেশীরা প্রচারমাধ্যমকে নেতৃত্বের ভূমিকায় দেখতে চায়, কিন্তু সাংবাদিকরা লোকানুবর্তিতার কাছে আত্মসমর্পন করেছে এবং কর্তৃপক্ষের ভয়ে আতংকগ্রস্ত হয়ে পড়েছে।

এক বছর পরেও অবস্থার পরিবর্তন হয় নি; প্রকৃতপক্ষে পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ হচ্ছে।

আনহার্ড ভয়েস ব্লগ বাংলাদেশী প্রচারমাধ্যমকে নিয়ে উৎকন্ঠিত হবার এমন কিছু ঘটনার বিবরণী দিয়েছে, এর মধ্যে সাম্প্রতিক সময়ের মর্মান্তিক কয়েকটা ঘটনা হচ্ছে:

মে ২, ২০০৮: যায়যায়দিন সম্পাদক শফিক রেহমান কোন কারণ উল্লেখ ব্যাতিরেকেই পদত্যাগ করেছেন এবং তুলনা মূলক অপরিচিত শহিদুল হক খান সে পদে আসীন হয়েছেন। তার প্রথম সম্পাদকীয়তে সরকারের প্রতি পক্ষপাত প্রদর্শন করা হয়েছে যা পত্রিকাটির জন্য একটা আমূল পরিবর্তন।
মে ১২: সব প্রধান (পত্রিকার) সম্পাদকবৃন্দ একটা যৌথ বিবৃতি দিয়েছে:
“এটা লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে, বিভিন্ন সামরিক ও বেসামরিক সংস্থা প্রচারমাধ্যমের কাজের হস্তক্ষেপ করছে”, বিবৃতিতে বলা হয়।
“জরুরী অবস্থার মধ্যে প্রচার মাধ্যমের স্বাধীনতা থাকে না। প্রচার মাধ্যমের প্রতিদিনের কার্যক্রমের উপরে নিয়মিত হস্তক্ষেপ গ্রহণযোগ্য নয়”, বিবৃতি বলা হয়।

ইন দ্যা মিডল অব নোহোয়্যার এর রুমি আহমেদ আরো ভেতরের চিত্র তুলে ধরেছেন:

যায়যায়দিনের এই সম্পাদকীয়তে আতাউস সামাদ/নুরুল কবিরের উদ্ধৃতি তুলে ধরা হয়েছে কিভাবে যায়যায়দিনের মালিক ডিজিএফআই (ডিফেন্স ফোর্সেস ইন্টেলিজেন্স) এর চাপে শফিক রেহমানকে চাকুরীচ্যুত করেছে। এই সম্পাদকীয়ের মাধ্যমে আমরা আরও জানতে পারি যে কয়েকটা ইলেকট্রনিক মিডিয়ার পরিচালককে এই সভায় (পরিচালকদের) আসতে নিষেধ করা হয়েছে।

তিনি প্রশ্ন করেছেন, “আমরা কি গেস্টাপো যুগে ফিরে গেলাম?”

বহুল প্রচারিত ইংরেজী দৈনিক দি ডেইলী স্টার এ এমন একটা রূপান্তর বেশ পরিবর্তন বেশ প্রকট। গত ফেব্রুয়ারীতে প্রকাশিত একটা সম্পাদকীয়তে বড়াই করা হয় যে দৈনিকটি ‘ভয় বা পক্ষপাত হীন সাংবাদিকতা'র ১৭ বছর পার করেছে। অথচ কিছু দিন পরেই মানবাধিকার পর্যবেক্ষণ যখন ডেইলী স্টারের একজন সাংবাদিক তাসনিম খলিল (সিএনএন ও হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ইন বাংলাদেশের প্রতিনিধি) এর প্রতিনিধি এর নির্যাতনকে গুরুত্ব দিয়ে একটা বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশ করে, এই পত্রিকাটি সে সংবাদ জানাতে বা মন্তব্য করতে অসমর্থ হয়। দি ডেইলী স্টারের একজন সাংবাদিক ই-বাংলাদেশ এ প্রতিবেদন সন্বন্ধে তার প্রতিক্রয়া ব্যক্ত করেছেন:

সংবাদপত্রের কণ্ঠ এখনও শক্তভাবে রোধ করা। আমরা এখনও আমাদের প্রতিবেদনে সামরিকদের কোন নেতিবাচক বিষয় সম্বন্ধে কিছু লিখতে পারি না। প্রায় বছরের বেশী সময় ধরে এমন চলছে। তাসনিম খলিল এবং আরিফুর রহমানের ঘটনা এই কারনেই ঘটেছে।

এখানে উল্লেখ করা যায় যে ডেইলী স্টারের সহযোগী বাংলা পত্রিকা প্রথম আলোর একটা সংখ্যায় প্রকাশিত অভিযুক্ত কার্টুনিস্ট আরিফুর রহমানের একটি নিরীহ কার্টুন (নবী মুহাম্মদকে উদ্ধৃতি করে) ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করা হয়েছে বলে সাজা দেওয়া হয়।

তার বিরুদ্ধে দেশদ্রোহিতার অভিযোগও আনা হয় এবং সম্প্রতি ছয় মাসের আটকাদেশের পর আদালত তাকে মুক্তি দেয়। যখন বাংলাদেশের বিশাল প্রচার মাধ্যম জগতের কেউ আরিফের কাহিনী শুনতে ও প্রকাশ করতে মাথা ঘামালো না, একজন ব্লগার ও সাংবাদিক অমি রহমান পিয়াল মুক্তির মাস খানেক পরে তাকে খুঁজে বের করে তার সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন এবং তার বাংলা ব্লগে তা প্রকাশ করেন (স্বাভাবিকভাবেই প্রধান প্রচার মাধ্যমগুলো তা প্রকাশ করতে রাজী হয়নি)। পোস্টটি শতাধিক মন্তব্যে সমৃদ্ধ হয় এবং প্রচারমাধ্যমকে এ বিষয়ে তাদের ভূমিকাকে তীব্রভাবে আক্রমন করা হয়।

আপনি এই সাক্ষাৎকারের ইংরেজী সংস্করণ পড়তে পারেন ই-বাংলাদেশে

এবং সবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল দি ডেইলী স্টারের সাম্প্রতিক ভূমিকা ঢাকা শহর ব্লগ প্রশ্নবিদ্ধ করলে বেশ কৌতুহল-উদ্দীপক একটি ঘটনা ঘটে। উক্ত পত্রিকার একজন সম্পাদক সেখানে তাদের কর্মকান্ড সাফাই গেয়ে মন্তব্য করতে থাকেন। পোস্টটি পত্রিকায় প্রকাশিত একটা উপ-সম্পদাকীয়ের ব্যবচ্ছেদ করে যেখানে আরো অনেক তোষণের মত বলা হয় পোস্টটিতে ছেঁটে ফেলা হয় একটা পত্রিকায় যেখানে বলা হয় বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার উপরে কোন নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয় নি এবং বলে:

বাংলাদেশে প্রথম বারের মত সাংবাদিকদের উপরে কোন নিপীড়ন, শাস্তি প্রদান বা হেনস্তা করার ঘটনা ঘটে নি। জরুরী অবস্থা জারি কৃত একটা দেশে এমন ঘটনা নজির বিহীন।

ঢাকা শহর তুলে ধরে:

কিন্তু এই পত্রিকার সম্পাদকেরা নিশ্চিতভাবেই জানে যে তাদের একজন সহকর্মী (তাসনিম খলিল) এর ভাগ্যে কি ঘটেছিল গত মে মাসে!

মন্তব্যের অংশে উত্তপ্ত বিতর্কের ঝড় বয়ে যায় যখন ডেইলী স্টারের এই উপ-সম্পাদকীয় সম্পাদক অজুহাত দেখান যে এটা ভুলে প্রকাশ করা হয়েছিল কারণ লোকবলের অভাবে তারা উপ-সম্পদাকীয়র তথ্যের সত্যতা যাচাই করতে পারে নি।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন মন্তব্য করেছেন:

উপ-সম্পাদকীয় যদি সংশয় থেকেও থাকে – বিষয়টি ছিল স্পষ্টত:ই অস্বীকার, এবং বাংলাদেশের সাংবাদিকতার সাথে জড়িত যে কাউকে প্রচণ্ড মাত্রায় গর্দভ হতে হবে এই খবর সম্পর্কে অজ্ঞ থাকতে।

তাহলে প্রচার মাধ্যমের এ ধরনের কর্মকান্ডের উদ্দেশ্য কি – তাদের কি বাধা বা চাপ প্রদান করা হচ্ছে অথবা মালিকের অর্থনৈতিক স্বার্থে বিঘ্নিত হতে ন দেয়া? এখন কোটি টাকার প্রশ্ন হচ্ছে কিভাবে প্রচার মাধ্যম এই স্বআরোপিত নিয়ন্ত্রণের হতাশাজনক গহ্বর এবং তোষণ থেকে কিভাবে মুক্তি পাবে এবং সত্য বলতে সাহসী হবে?

আলোচনা শুরু করুন

লেখকেরা, অনুগ্রহ করে লগ ইন »

নীতিমালা

  • অনুগ্রহ করে অপরের মন্তব্যকে শ্রদ্ধা করুন. যেসব মন্তব্যে গালাগালি, ঘৃণা, অবিবেচনা প্রসূত ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকবে সেগুলো প্রকাশের অনুমতি দেয়া হবে না .