মালদ্বীপ সরকার গত শুক্রবার রাজধানী মালেতে বাংলাদেশী প্রবাসী শ্রমিকদের একটি প্রতিবাদ সমাবেশ অনুষ্ঠান করা থেকে বিরত রেখেছে তাদের দেশে ফেরত পাঠিয়ে দেয়ার ভয় দেখিয়ে। এই বাংলাদেশীদের বেশীরভাগই অদক্ষ শ্রমিক যারা প্রতিবাদ করছে মালদ্বীপে বিদেশীদের উপর বিদ্বেষ এবং বিশেষ করে বাংলাদেশীদের প্রতি ক্রমবর্ধমান আক্রমনের বিরুদ্ধে।
আগস্ট মাসে মালেতে বাংলাদেশী শ্রমিকদের বাসস্থানে কিছু সংগঠিত দল উপুর্যপরী হামলা চালায়। উত্তরের কুলহুদুফ্ফুসি দ্বীপে একজন বাংলাদেশী শ্রমিককে পুরষাঙচ্ছেদ করে বর্বরভাবে মারা হয়েছে। পুলিশ তার সাথী একজন বাংলাদেশী শ্রমিককে আটক করেছে এবং বলছে যে এটির পেছনে যৌনতা কারন ছিল। এছাড়াও অপর দুটি ঘটনায় মালের দুই বাসায় দুই বাংলাদেশীকে লোহার চেইন দিয়ে আটকাবস্থায় পাওয়া যায়। এদের মধ্যে একজনকে গাছের সাথে বেঁধে রাখা হয়েছিল।
মালদ্বীপে বাংলাদেশী হাই কমিশনার এই সব ঘটনায় এতটাই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন যে তিনি সতর্ক করে দিয়েছেন বাংলাদেশী শ্রমিকদের মালদ্বীপ থেকে তুলে নেয়া হতে পারে।
মালে হচ্ছে দুই বর্গকিলোমিটারের একটি ছোট দ্বীপ। এখানে প্রায় ৩০,০০০ বিদেশী শ্রমিক বাস করে যাদের মধ্যে বেশীরভাগই প্রতিবেশী রাষ্ট্র শ্রীলন্কা, ভারত ও বাংলাদেশ থেকে এসেছে। এদের বেশীরভাগই অদক্ষ শ্রমিক যারা মাত্র ১০০ আমেরিকান ডলার পারিশ্রমিকেই সন্তুষ্ট হয়ে এখানে কাজ করে। বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই এদের দেশে রেখে আসা পরিবারগুলো এদের আয়ের উপর নির্ভরশীল।
মালের অধিক জনসংখ্যা এবং জায়গার অভাব হাউজিং ইন্ডাস্ট্রীর চাহিদা বাড়িয়ে দিয়েছে। ফলে মালের বাড়ীভাড়া পৃথিবীর অনেক দেশের তুলনায়ই অত্যাধিক বেশী। গত ১৫ বছরে বাড়ী নির্মানের আধিক্য তাই বিদেশী শ্রমিকদের চাহিদা বাড়িয়ে দিয়েছে।
যদিও এদেশে প্রবাসী দক্ষ ও পেশাদারীরা রয়েছেন যেমন, ডাক্তার, শিক্ষক এবং হিসাবরক্ষক, এই বিদেশী বিদ্বেষ শুধুমাত্র এই অদক্ষ শ্রমিকদের বিরুদ্ধেই দেখা যায়। সাম্প্রতিককালে এমন রিপোর্টও পাওয়া যাচ্ছে যে দেশের ট্যুরিস্ট রিসোর্টে বিদেশী শ্রমিকদের উপর আক্রমন হয়েছে। এইসব টুরিস্ট রিসোর্ট আসলে একেকটি দ্বীপ যেখানে ইউরোপীয়রা ছুটি কাটাতে আসে এবং তারা হয়ত জানেনা যে এই স্বর্গে আসলে কি ঘটে।
এই বিদেশী বিদ্বেষের বৃদ্ধি হয়ত মালদ্বীপে অপরাধ প্রবনতার বৃদ্ধি এবং গ্যাঙ সংস্কৃতির বৃদ্ধির সাথে সম্পর্কযুক্ত। মালদ্বীপের বেশ কিছু যুবা এখন হেরোইন আসক্ত।
বিদেশীদের প্রতি এরুপ বিদ্বেষ ছাড়াও আরেকটি চিন্তার বিষয় হচ্ছে মালিক কর্তৃক এইসব বিদেশী শ্রমিকের উপর নির্যাতন। সাধারনত: বিদেশী শ্রমিকরা বেশী সময় কাজ করে কম মজুরী পায়। প্রায়শ:ই তাদের বাসস্থান খুবই নিন্মমানের হয়। এটি বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়না যে মালদ্বীপে আসলেই কোন শ্রমিক আইন নেই এবং মালদ্বীপের শ্রমিকরাও তাদের অধিকার থেকে বন্চিত হচ্ছে। এদের কোন ন্যুনতম মজুরী নেই।
বিদেশী শ্রমিকদের প্রতি এই বিদ্বেষ পূর্বেও দেখা গেছে। কিন্তু সমস্যাটি দুরীভুত হয়নি। পারস্য উপসাগরের আরব রাষ্ট্রগুলোতে দক্ষিন এশিয়ার শ্রমিকদের উপর নির্যাতনের উপর আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর রিপোর্ট বের হয়েছে। কিন্তু মালদ্বীপের বাইরে খুব কম লোকেই জানে যে দক্ষিন এশিয়ার শ্রমিকদের উপর আরেকটি দক্ষিন এশিয়ার লোকেরাই অমানুষিক ব্যবহার করছে।
ব্লগার জা মালদ্বীপের সমাজের সমালোচনা করেছে বিদেশী বিদ্বেষের জন্যে এবং প্রবাসী শ্রমিকদের উপর করা অত্যাচারের বিবরন দিয়েছে:
আমরা (মনে হয়) একসময় সহনশীল একটি জাতি ছিলাম যারা সব ধরনের বিদেশীদের আমন্ত্রন জানাতাম এবং তাদের সম্মান করতাম। কিন্তু অবস্থা এখন খারাপের দিকে গেছে। মানবতা এবং সমতার ধারনাগুলো যেই পরিমানে কলুষিত হয়ে গেছে যে এখন বিদেশী বিদ্বেষ ছড়িয়ে গেছে সর্বত্র আর বর্নবাদ ছড়িয়ে পরছে আগুনের মত। তাই বিদেশী শ্রমিকদের উপর অন্যায় ব্যবহার এবং অসম্মান এখন সত্য ঘটনা যা সবাই জানে। আমরা প্রায়শ:ই এই অদক্ষ শ্রমিকদের মানুষ বলে স্বীকার করতে চাই না। আমার এও বলতে ইচ্ছে হচ্ছে যে এদের আসলে আমরা দেখি কাজ করার মেশিন হিসেবে যাদের কোন অনুভূতি নেই এবং তাদের জীবনের মূল্য আমাদের পোষা বিড়ালের থেকে বেশী নয়। তাদের আমরা থাকতে দেই ছোট টিনের চালায় যেখানে আলো বাতাস কম ঢুকে এবং এত লোক সেখানে আঁটাই যেন ওটি সার্ডিন মাছের টিনের মতো মনে হয়। তারা ঘরে এবং কর্মস্থলে উভয় যায়গায়ই লান্ছিত হয়। আপনারা অনেকবারই দেখবেন এইসব শ্রমিকরা প্রাপ্য বেতন পাবার জন্যে কাঁদছে ও ভিক্ষা করছে। অনেক সময় মাসের পর মাস চলে যায় কিন্তু চাকুরিদাতার এদের (যতকিন্চিত) বেতন দেয় না যেগুলো এরা তাদের দেশে অভুক্ত পরিবারকে পাঠায়। চাকুরিদাতাদের নিয়ন্ত্রনে রাখার জন্যে পর্যাপ্ত আইন নেই, ফলে এই শ্রমিকদের বেশী সময় ধরে কাজ করানো সহজ। কর্মস্থলে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার বালাই নেই। এছাড়াও তাদের অফিসিয়াল কাজ শেষ হলে চাকুরিদাতারদের ফাই ফরমাস খাটতে লাগানো হয়। আসলে তারা তাদের পোষা দাসেরই মতো। আমি স্থানীয় জনপ্রিয় পত্রিকা হাভেরু পত্রিকাতে চাকুরিদাতার পরিবর্তে “মালিক” শব্দটিই ব্যবহার করতে দেখেছি কুলহুদুফ্ফুসি দ্বীপে বাংলাদেশী শ্রমিকের মৃত্যুর সংবাদটিতে (মালিক? এটি দাসত্বের মানসিকতা নয়?)।
দেশ থেকে বের করে দেওয়ার ভয়ই যথেষ্ট ছিল বাংলাদেশী শ্রমিকদের আন্দোলন দমাতে। এটি বিষ্ময়কর নয় কারন ২৮ বছর ধরে দেশের রাষ্ট্রপতি থাকা মামুন আব্দুল গাইয়ুম মালদ্বীপবাসীদের আন্দোলন থামাতেও এরুপ পন্থাই অবলম্বন করেন। কিন্তু এই নিস্তব্ধতার ভেতরে বিদেশী শ্রমিকরা, বিশেষ করে বাংলাদেশীরা ভয়েই দিন কাটাচ্ছে।
- নিহান জাফর