কোরিয়া: সামসুংম্যান হিসাবে বাঁচা

সামসুংম্যান (সামসুং কোম্পানীতে কাজ করে যে) হচ্ছে একটি বিশেষ টাইটেল যা একজন মানুষকে কোরিয়ান বনেদি গোত্রের কাতারে নিয়ে যায়। এটি কোন মানুষ সম্পর্কে এই ধারনা এনে দেয় যে সে ‘উচ্চমেধাসম্পন্’ ‘অধিক আয় করে’ এবং ‘সবচেয়ে যোগ্যতাসম্পন্ন স্বামী’ (মেয়েদের ব্যাপারটা জানিনা কারন সেরা স্ত্রী এই শব্দটি শুনিনি)।

মে মাসে একজন সামসুংম্যান তার সেই সেরা চাকরি থেকে ইস্তফা দিল যে চাকরীর জন্যে লোকে পাগল। একবছরের মাথায় সে সামসুং থেকে পদত্যাগের কালে কেন চাকরিটি ছাড়ল তা বর্ননা করা ইস্তফার চিঠি কোম্পানীর ওয়েবসাইটে তুলে দিল। তার সেই লম্বা চিঠি সব কোরিয়ান ব্লগে আলোচনার বিষয়বস্তু হল। আমি এর সারাংশ নীচে তুলে ধরছি:

একবছরের মাথায় আমি আমার ভালবাসার কোম্পানী ছেড়ে চলে যাচ্ছি। অথচ আমার কোন বিকল্প পরিকল্পনা নেই। আমি যাচ্ছি না অন্য কোথাও চাকরি নিয়ে অথবা শুরু করছিনা উচ্চ শিক্ষা। কিন্তু এখন এই সিদ্ধান্তই আমাকে নিতে হচ্ছে। এখানে কাজ শুরু করার পর বহু ঘটনা ঘটে গেছে যা আমি বুঝতে পারছিনা। তারা কেন এক বেশী মদ্যপান করে? এবং তারা কেন সবসময় কোম্পানীর ক্রডিট কার্ড ব্যবহার করে? কেন কাজের সময়ের পর এত ডিনারের এপয়েন্টমেন্ট যা সাধারনত: কেউ পছন্দ করে না? তারাতো পারে অফিসের সময়ের মধ্য কাজ শেষ করতে এমনকি নিজেদের ভবিষ্যতের জন্যও কাজ করতে। কিন্তু কেন তারা অফিসের সময়ে ধীরলয়ে কাজ করে যেন ওভার-টাইম প্রাত্যহিক গতানুগতিক ব্যাপার? কর্মক্ষমতা থেকে যোগাযোগই কি বেশী গুরুত্বপুর্ন?

এই সব প্রশ্ন এই কোম্পানীর জন্যে অবান্তর। এই বাজারে টেকার জন্য কোম্পানী কালচার হওয়া উচিৎ নমনীয় এবং খোলামনের। প্রতিনিয়ত সৃজনশীলতা এবং পরিবর্তন আনা দরকার। সহকর্মীদের মধ্যে সমান্তরাল সম্পর্ক থাকা উচিৎ এবং বেতন কাঠামো হওয়া উচিৎ কর্মচারীর কর্মক্ষমতা ও সাফল্যর উপর ভিত্তি করে। কর্মচারীদের মধ্যে উদ্যম নিয়ে কাজ করার স্প্রীহা থাকতে হবে পিছিয়ে না পরার জন্যে, মদ্যপান নয়, উচ্চশিক্ষা দরকারী.. যদিও এতকিছুও কোম্পানীর ভবিষ্যতকে (৫ বা ১০ বছর পর) নিরাপদ করে না।

অথচ এই কোম্পানী এত ধীরপরিবর্তনশীল কেন? এই ধ্যানধারনা নিয়ে কিভাবে কোম্পানীর টাকা আয় করা ও তা ধরে রাখা কি সম্ভব? আমি বুঝতে পারিনা। কোম্পানীর প্রতিজ্ঞাবদ্ধ কাজের সময় রয়েছে। কিন্তু আমি হতাশ হই যখন আমাকে মুল কাজের পরও অতিরিক্ত সময় দিতে হয় কাজের বাইরের ব্যাপারের জন্য (যেমন নতুন সংস্কৃতি দিবস)। এধরেনর বিষয়গুলো কর্মচারীদের উপর চাপানো হয় একতরফা ও আপসহীনভাবে।

যখন আমাদের দরকার ১০০% বিপ্লব আমরা করি ৩০%, কিন্তু ভান করি ১০০% করার। অর্থাৎ ছেড়ে দেই ৭০%।আমাকে আরও হতাশ করে যখন দেখি অন্য কর্মচারীরা কোন আপত্তি ছাড়াই এগুলো করে যাচ্ছে।আমার ভয় হচ্ছে যে আমি ক্রমান্বয়ে এই সিস্টেমে অভ্যস্ত হয়ে যাব। এইসব কার্যকলাপকে এড়ানোর মত অথবা মুখফুটে সহ্য করার মত ক্ষমতা আমার নেই। কেউ কেউ বলে যে আমি যদি এতই অসুখী হই আমি কোম্পানিতে পরিবর্তন আনতে সক্ষম হব। কিন্তু আমার উপর আর কোন আস্থা নেই এখানে থাকার জন্যে….

তার চিঠি ব্লগোস্ফিয়ারকে দুই ভাগ করে ফেলেছে: একদল তার পক্ষে এবং একদল বিপক্ষে বলছে। এখানে একজনের বক্তব্য যে তার পক্ষ রয়েছে:

সামসুংম্যান ইস্তফা দিয়েছে। সে নিশ্চয়ই রক্তাশ্রু চোখে তার চিঠিটি রেখে এসেছে। কিন্তু এটি শুধু সামসুংম্যান এর গল্প নয়। হতে পারে আমাদের যে কারও গল্প। এটি আমারও গল্প। অন্য যে কোন যুবক যে তার কর্মজীবন শুরু করেছে তার গল্প। সামসুং এ চাকরী পেতে তার নিশ্চয়ই বেশ কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। তার নিশ্চয়ই একটি স্বপ্ন ছিল এবং সেভাবেই তার জীবনকে সাজিয়েছে। কাজ শুরুর প্রথম বছর সবারই কঠিন সময় যায়। নতুন পরিবেশে নতুন সংস্কৃতিতে তারা বেশ সমস্যা এবং চাপের মধ্য পরে। সবকিছুই তারা শিশুদের দৃষ্টিতে দেখে কারন সার্বজনীনভাবে দেখার মত অভিজ্ঞতা তাদের তখনও হয়না। কিন্তু আমাদের সমাজের কর্মপ্রচেষ্টাগুলো থাকে এইসব নবীনদের আবেগকে রুদ্ধ করা – এই হচ্ছে আসল সমাজ,.. এই হচ্ছে সিস্টেম,..তাই এভাবেই মানিয়ে চলবে.. এই তাদের ভাষ্য। দ্বাবিংশ শতাব্দীতে এইসব সিস্টেমকে আপন করে নেওয়াকে বশ্যতাস্বীকারও বলা যায়। কিন্তু এই যে এখন আমরা পড়াশোনা করছি, চুলের স্টাইল ও চেহারা নিয়ে ভাবছি এইসবের জন্যেই।

একবছরে কোম্পানীর সাথে মানিয়ে নেয়ার পর সময় এই সম্পুর্ন সিস্টেমের সাথে মানিয়ে নেয়ার পালা। মাসিক বেতনের প্রলোভন এড়ানো কষ্ট। এবং তারপর তুমি প্রেম কর, বিয়ে কর , বাচ্চার পিতামাতা হও.. মাসিক বেতন অবশ্যই জীবনের গুরুত্বপুর্ন একটি বিষয় হয়ে দাড়ায়। মানুষের জীবন বেতনের সাথে বাঁধা।

অবশ্য এটি প্রমান করেনা যে সব বেতনভুক্ত মানুষ মাত্রেই কাপুরুষ। এটি জীবনেরই অংশ এবং আমরা সবাই তা জানি। একসময় আমরা বুঝতে পারি জীবন বড় কঠিন এবং কখনও এটি মানতে পারা খুব কষ্টের হয়। তাই তখন আমরা মদ্যপান করি এবং ৪০-৫০ বছরের মধ্যে জীবন থেকে মুক্তি পাই।

আমি এই একবছর কাজ করা সামসুংম্যান এর সাহসীকতাপুর্ন সিদ্ধান্তকে সম্মান করি। তার বীরত্বকে আমি পুজা করি। সমাজের গতানুগতিক সিস্টেমের সাথে অঙাঅঙিভাবে মিশে যাওয়া কোন ব্যক্তি পুজনীয় হতে পারে না। এরকম আরও লোক দরকার যারা এই সিস্টেম থেকে বের হয়ে আসতে পারে হোক সে সামসুংম্যান, ডাক্তার বা উকিল।

তার বিপক্ষে বলছেন রেসিস্ট৭৫ এর মত আরও অনেকে:

সামসুংম্যান.. তারা অনেক মদ্যপান করে। কিন্তু তাদের নিন্দা করা কঠিন। তারা যদি শুধু রিসার্চার বা ম্যানেজার হিসাবে কাজ করে তাহলে তাদের পানের সংস্কৃতি নিয়ে নিন্দা করা সাজে। কিন্তু আমাদের কি তাদের বাদ দিয়ে অভ্যর্থনা সংস্কৃতি (jeop-dae mun-hoa) কে নিন্দা করা উচিৎ নয়? এটাতো নয় যে সামসুংম্যানদের স্বভাব পরিবর্তন করা উচিৎ, অভ্যর্থনা সংস্কৃতি থেকে মদ্যপান বাদ দেয়ার কথা আমরা ভাবছিনা কেন? তারা তো তাদের পন্য এখানে ওখানে বেঁচার জন্যে চেষ্টা করে থাকে, সমাজ বা সংস্কৃতি পরিবর্তনের চেষ্টা তো করে না।

যাই হোক তার লেখায় তিনি কখনই ব্যক্ত সমস্যাগুলো সমাধানের চেষ্টা করেননি। তার চিঠিটি কি এটিই প্রমান করে না যে তার ইস্তফার কারন হচ্ছে কোম্পানিটি তার স্বপ্নের কোম্পানী নয় এবং তিনি এর থেকে মুক্ত হতে চাচ্ছেন? এর মানে হচ্ছে তিনি সিস্টেমের সাথে মানিয়ে নিতে পারেননি। সামসুং সম্পর্কে বিজ্ঞাপন দেখে তিনি কি অলীক স্বপ্ন দেখেছিলেন? অন্য সব মানুষই কি তেমন আদর্শ জীবন যাপন করে? আপনার কি মনে হয় পুলিশরা চোর-ডাকাত ধরার সময় সবসময় রোমান্চ অনুভব করে? আসলেই কি ফায়ারফাইটাররা মানুষের জীবন বাচানোর জন্যে সর্বদা তাদের জীবন উৎসর্গ করে? এগুলো বরং তাদের জীবনেরই সাধারন মুহুর্ত।

আমার মনে হয় তিনি এই কোম্পানিতে কাজ করতে চাননি তাই এর সিস্টেমের সাথে কোনদিন মানিয়ে নিতে চাননি। ফলে শিশুদের মতই তিনি পদত্যাগ করেছেন।

wo3n এর মত কিছু ব্লগার সামসুংম্যানের অবিবেচক সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেছেন।

এই চিঠিটি পড়ে আমার দু:খ পেয়েছে এবং একইসাথে আমি ক্রোধান্বিত হয়েছি। তার কিছু অংশের সমর্থন করি আমি। সমাজ এবং তার কোম্পানী সম্পর্কে তার কিছু দৃষ্টিভঙী সঠিক। কিন্তু আমি দু:খিত হয়েছি এই দেখে যে সে হার মেনেছে এবং পরাজিত হয়েছে। জীবনের পথ সব সময় কন্টকহীন হয়না। আমি ক্রোধান্বিত হয়েছি তার এই ধারনায় যে সে সঠিক আর জগৎ সংসার ভুল। সে নিজেকে একজন সঠিক মানূষ হিসেবে চিন্হিত করতে চেয়েছে যে ইস্তফা দিয়ে কোম্পানীর পন্কিলতা থেকে বাঁচতে চাচ্ছে। সে অন্য বেতনভুক্তদের সহজ জীবন যাপনের জন্যে আপসকারী হিসাবে দেখানোর আস্পর্ধা দেখিয়েছে। তার লেখা তার সহকর্মীদের জন্যে অপমানজনক। যে কোন বিচার তথ্য প্রমানের ভিত্তিতে করতে হয়। সে সেখানে একবছরেরও কম কাজ করেছে। কোম্পানী তার কাছে কি চায় সেটা হয়ত তার কাছ সঠিকভাবে পৌছায়নি। অথবা সে হয়ত তখনও বুঝতে পারেনি। বোঝার ব্যাপারটা তখনই পুর্ন হয় যখন তথ্যের পরিমান ও গভীরতা পর্যাপ্ত হয়।

- হেইজিন কিম

আলোচনা শুরু করুন

লেখকেরা, অনুগ্রহ করে লগ ইন »

নীতিমালা

  • অনুগ্রহ করে অপরের মন্তব্যকে শ্রদ্ধা করুন. যেসব মন্তব্যে গালাগালি, ঘৃণা, অবিবেচনা প্রসূত ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকবে সেগুলো প্রকাশের অনুমতি দেয়া হবে না .